সময়ের সাথে সাথে রবিন বড় হয়ে উঠল। বারান্দার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে সে বলে, আকাশ তুমি কত না বিশাল, তোমার নিচে বাস করছে কত না মানুষ। এ বিশাল আকাশের নিচে মানুষগুলো চেনা বড় দায়, যেমন চিনতে পারল না ছেলে তার বাবাকে। বাবা, তুমি তোমার স্বার্থপর ভালোবাসার কাছে আমাকে আর মাকে পর করে দিলে। তুমি তোমার ভালোবাসাটাকেই দেখলে। আমার চোখের সামনে আমার মা কত কষ্ট না করল, স্বামী বেঁচে থেকেও আমার মার স্বামী নেই। তোমার সব আছে, কিন্তু তার উপর ছেলে হিসাবে আমার কোন অধিকার নেই। তোমার দ্বিতীয় বিয়ে সবার অধিকার থেকে তোমাকে হারাল। বাবা, কাউকে কোন সুখ দিতে পারলে না তুমি।
শাহানা ছেলের পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধের উপর হাত রেখে বলে, তুই কিছু ভাবছিস বাবা? এখানে চুপচাপ দাড়িয়ে আছিস যে। রবিন মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওমা আমি কোন কিছুই ভাবছি না। মা, আমাকে লালন পালন করতে গিয়ে কতই না কষ্ট করতে হয়েছে তোমাকে।
ধুর বোকা। মার কাছে ছেলে মেয়ে লালন পালন করতে কোন কষ্ট হয়? এ যে মার কাছে পরম সুখ। আমি বেশ ভালো আছি তোকে নিয়ে।
রবিন বলল, মা তুমি সুখে না থেকেও বলো যে ভালো আছি। তোমার মত কতজন বলতে পারে আমি সুখে আছি। মা তুমি যে আমার পৃথিবীর সুখ। যেদিকে তাকাই শুধু তুমি ‘মা’।
ওরে আমার খোকন সোনা বলে কী!
মা তুমি যদি এ চাকরিটা না করতে তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম? শাহানা বলল, আল্লাহ আমাদের কোন এক ব্যাবস্থা করে দিতেন। যেমন এখন আমার সেই ছোট্ট ছেলেটা, হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ এইচএসসিতে পড়ে।
ঠিক আছে মা এখন আর দেরি করব না, আমার কলেজে যাওয়ার সময় হয়েছে।
ঠিক আছে, বাবা দেখে শুনে যাও।
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রবিন বলে, ঠিক আছে মা।
রবিন খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে। ক্লাসে সে সবসময় শান্ত হয়ে থাকে। কলেজে কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কেউ কোন কথা জিজ্ঞেস করলে তার কথায় উত্তর দেয়। নিজ থেকে কোন কথা বলে না। কলেজে তার তেমন একটা বন্ধু বান্ধবী নেই। তার একটাই মনের মধ্যে ধারণা— পড়ালেখা ভালোভাবে করতে হবে। সে একজন মেধাবী ছাত্র। জীবনে একটা কিছু করতে হবে। মাকে ছাড়া সে কাউকে চেনে না। এমন কী নিজের কোন আত্মীয়—স্বজনকেও না। তার মা তাকে নিয়ে কখনো কারও কাছে যায়নি। কারণ নিজের স্বামীকে সে কখনো ছোট করতে চায়নি। এর সমাধান তো কেউ দিতে পারবে না। তাই নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে।
কলেজে একটি মেয়ে সব সময় রবিনকে অনুসরণ করে। নাম তার রেমা। রেমা ভাবে, ছেলেটি কেন এত চুপচাপ? কারো সাথে কথা বলে না। ওর সাথে কেন আমার কথা বলার জন্য মন উত্তাল হয়ে থাকে? ওর সাথে আজ আমি কথা বলব। রেমা তার বান্ধবী অনাকে বলে, অনা শোন্। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।
কার সাথে? ওই যে ওর সাথে।
কি বলছিস, কার সাথে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ওই যে ওই ছেলেটার সাথে, ক্লাসে শান্ত হয়ে বসে থাকে। কারো সাথে কোন কথা বলে না।
আরে ও কোন কথা বলতে পারে না শুধু পড়ালেখা ছাড়া। আমার মনে হয় ও কথাই জানে না।
তুই যে কী বলছিস না, চল ওর সাথে কথা বলি।
আমি না, তুই যা। তুই গিয়ে যা বলার বল।
চল না, এমন করিস কেন?
গুটি গুটি পায়ে দুই বান্ধবী রবিনের পাশে গিয়ে বসল। রবিন কিছুই বলছে না। একটু নড়েচড়ে সরে বসে। রেমা বলে, আচ্ছা বলুন তো, আপনি এমন গম্ভীর হয়ে থাকেন কেন? রবিন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কী, কোন কথাই বলছেন না যে।
আমার একা থাকতে ভালো লাগে।
ঠিক আছে, কিন্তু আমরা এখানে যারা ক্লাসে আছি সবাই সবার বন্ধু। আমার পড়ালেখার কোন ব্যাপারে কথা বলতে পারি?
আমার সব ব্যাপারে নিজেকে একা রাখতে ভালো লাগে।
ভালো স্টুডেন্ট বলে?
থাক না বেচারা একা থাকতে চায় একা থাকতে দে। অনা বলল।
না আমি ওকে একা থাকতে দিবো না।
একথা শুনে রবিন হেসে দিলো।
হাসলেন কেন, আমার কথায় হাসি পায়?
গায়ে পড়ে কথা বলা আমার একদম ভালো লাগে না।
রবিনের কথা শুনে রেমা খুব ক্ষেপে গেল। বলল, আমি আপনার সাথে কথা বলছি। গায়ে পড়ে কথা বলছি, মোটেও তা নয়। আপনার মতো এমন গম্ভীর লোক কোথাও দেখিনি। উল্লুক নিজে কথা বলতে জানে না তাতো বলবে না। শুনুন, আমি কিন্তু আপনার প্রতি ক্ষেপে গেছি, আমার রাগ হচ্ছে আপানার প্রতি।
শুনলাম তো। বলা শেষ হয়েছে?
হঁ্যা, শেষ হয়েছে।
এবার তাহলে ক্লাসে গিয়ে বেঞ্চে বসুন।
আমি আমার বেঞ্চে গিয়ে বসবো, কিন্তু আপনার চোখের আড়ালে।
হঁ্যা তাই করেন।
শুনুন, চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হওয়া যায় না, বুঝেছেন?
রবিন মাথা নাড়ল। ক্লাসশেষে বাসায় ফিরে এলো রবিন। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা যতক্ষণ তোমার সামনে থাকি মনে হয় পৃথিবী আমার কাছে, আর যখন তোমার আড়ালে থাকি মনে হয় সবকিছুই যে আমার অন্ধকার।
শাহানা বলল, পাগল ছেলে আমার। আয়, তোর হাত মুখ ধুয়ে দেই। খেতে হবে তো, ক্ষুধা লাগছে না?
মা, আমি এখনো কি ছোট নাকি? বড় হয়েছি না? আমি তোমার ইন্টারে পড়া ছেলে, এখন কেন তোমাকে আমার হাত মুখ ধুয়ে দিতে হবে।
ও আমি তো ভুলে গেছি, ছেলে আমার বড় হয়েছে। তারপরও মায়ের কাছে সন্তান ছোটই থাকে বাবা।
ঠিক আছে মা, আমি তোমার স্নেহের স্থানে ছোট বাবু হয়ে থাকতে চাই। শাহানা ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো তোকে বুকে নিয়েই তো বেঁচে আছি বাবা। তোর বাবা ছেলে জন্ম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছেলের দায়িত্ব তো পালন করেনি। মানুষের স্বার্থপর ভালোবাসা মানুষকে কত দূর নিয়ে যায়! ভুলিয়ে দেয় তার জীবনের অন্য কোন সম্পর্কের কথা। হায়রে মানুষ! তোকে বোঝা দায়। ভাবতে ভাবতে শাহানা স্মৃতির গহীনে হারিয়ে যায়। ছেলের কথা ভুলে যায়। রবিন বলে, মা বসে চুপ হয়ে আছ যে?
ও, বাবা তুই কিছু বলছিস?
মা, তুমি কিছু ভাবছ?
নারে বাবা, চল খাবি।
মা ছেলে এক সাথে খেয়ে নেয়। রবিন মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, মা বাবা তো তার ছেলের খেঁাজ না নিয়ে পারল। মা, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারলে না। যেখানে আছো আমাকে নিয়েই আছো।
কেন বাবার কথা মনে পড়ছে?
না মা, তা পড়ছে না। মনে হলো বাবা তার সন্তানের খেঁাজ না রেখেও পারে, কিন্তু মা পারে না।
মায়ের যে নাড়িছেঁড়া ধন, সে কি পারে? তবু আমি তো সব দিতে পারলেও বাবার পূর্ণতা দিতে পারছি নারে।
না মা, তা নয়। তোমার মতো এত ভালোবাসা বাবা কি দিতে পারত? পারতো সে আমায় নিয়ে একা থাকতে? আর কোন প্রকৃত বাবাই পারে না তার সন্তানকে রেখে দূরে থাকতে।
সবাই নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে অন্যের জন্য কিছু করতে পারে না, সেও হয় তো পারছে না। যদি তোমার বাবার কথা মনে পড়ে তাহলে যাও বাবার সাথে গিয়ে দেখা করো।
মা, যে বাবা নিজে সন্তানের ভুলে থাকতে পারে তার সাথে আমার দেখা করেই বা কী হবে? সে তার মতো করে থাক।
আমার যতটুকু করার আমি ততটুকু করতে পারি। অন্যের মনের উপর তো জোর খাটাতে পারি না। তাও যদি পারতাম আমি তোর জন্য করতাম।
মা, তুমি আমার জন্য কী না করেছ? আমি চাই না এমন বাবাকে।
পরের দিন রবিন কলেজে এলে তাকে দেখে রেমা বলল, আজ দেখি তুমি কীভাবে নীরব থাকো, আমি তোমাকে নীরব থাকতে দিচ্ছি না। রেমা স্যারের কাছে গিয়ে বলে, স্যার, আমি একটা কথা বলতে চাই।
বলো কী বলতে চাও?
স্যার, আমাদের কলেজের খেলায় সবাই কমবেশি অংশগ্রহণ করে, কিন্তু রবিন করে না। ওকে আপনি বলে যদি কোন খেলায় অংশগ্রহণ করাতেন।
দেখো, খেলা হচ্ছে মনের আনন্দ। এখানে যার ইচ্ছা সে খেলবে, যার ইচ্ছা সে খেলবে না।
স্যার, তারপরও আপনি যদি বলতেন।
আচ্ছা, আমি দেখবো— বলে স্যার রবিনকে ডাকলেন। রেমা অনেক খুশি এবার। রবিনকে দেখে হাসতে লাগল।
স্যার, আমাকে ডেকেছেন?
হঁ্যা রবিন, আমি তোমাকে যে জন্য ডেকেছি— আমাদের কলেজে খেলা চলছে। আমি চাই, তুমি তার মধ্যে যে কোন খেলায় অংশ নাও।
স্যার, আমি এ পর্যন্ত স্কুল—কলেজের কোন খেলায়ই অংশগ্রহণ করিনি।
যা এতদিন করোনি তা এখন করবে। আর করোনি বলে এখন করবে না তা কি হয়?
স্যার, আমার দ্বারা খেলাধুলা হবে না।
সবার দ্বারা সবকিছু সম্ভব যদি তার ইচ্ছা ও মনোবল থাকে। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।
রেমা মুখ খিঁচিয়ে ভেংচালো। তারপর নাকের উপর হাত দিয়ে ডলা দিল। রবিন তা লক্ষ্য করল। তারপর বলল, স্যার আমি খেলব।
আমি বললাম, তুমি পারবে। তুমি নিজের প্রতি আস্থা রাখো। প্রতিটি মানুষ যদি তার নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারে তাহলে সে যেটাই চায় তা তার সেটা পাওয়া সম্ভব।
রবিন কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দুটি খেলায় অংশগ্রহণ করতে নাম লেখায়। দৌড় আর বালিশ খেলা। আগে কখনো খেলেনি। তাই মনে একটু ভয় পাচ্ছিল। রেমার রহস্যময় হাসির কারণে রবিনের মনে জেদ চাপল।
রবিনের ব্রতঃ আমার এ খেলায় জিততে হবে। তারপর সে পুরোদমে প্রাকটিস শুরু করল। রেমা বলল, আমি তোমার সাথে বালিশ খেলায় অংশগ্রহণ করতে চাই। বালিশ খেলায় ছেলে মেয়ে উভয়ে অংশ নিতে পারে। রবিন বলল, আমি তোমার সাথে খেলতে চাই না। রেমা বলল, তুমি আমার সাথে খেলায় পারবে না। রবিন বলল, তোমার খেঁাচা মেরে কথা বলার অভ্যেসটা একটু বেশি, ঠিক আছে আমি তোমার সাথে খেলব।
যাক, শেষমেষ রাজি হলে।
তোমার কথা কেমন যেন লবণের ছিটার মতো।
যাক—বুঝলে ভালো, না বুঝলেও ভালো।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি তোমার পথে যাও, আমি আমার পথে।
রেমা রবিনের কানের কাছে গিয়ে বলল, তুমি যা—ই বলো না কেন আমাদের দুজনের পথ কিন্তু একটাই হবে।
তুমি মেয়েটা যে কী! একেবারে অসহ্য!
কেন, আমার জ্বালা বুঝি সহ্য করা যায় না?
একদম না।
তর্কশেষে দুজন দুদিকে চলে গেল।
ফিরে এসো
সুলেখা আক্তার শান্তা
সময়ের সাথে সাথে রবিন বড় হয়ে উঠল। বারান্দার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে সে বলে, আকাশ তুমি কত না বিশাল, তোমার নিচে বাস করছে কত না মানুষ। এ বিশাল আকাশের নিচে মানুষগুলো চেনা বড় দায়, যেমন চিনতে পারল না ছেলে তার বাবাকে। বাবা, তুমি তোমার স্বার্থপর ভালোবাসার কাছে আমাকে আর মাকে পর করে দিলে। তুমি তোমার ভালোবাসাটাকেই দেখলে। আমার চোখের সামনে আমার মা কত কষ্ট না করল, স্বামী বেঁচে থেকেও আমার মার স্বামী নেই। তোমার সব আছে, কিন্তু তার উপর ছেলে হিসাবে আমার কোন অধিকার নেই। তোমার দ্বিতীয় বিয়ে সবার অধিকার থেকে তোমাকে হারাল। বাবা, কাউকে কোন সুখ দিতে পারলে না তুমি।
শাহানা ছেলের পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধের উপর হাত রেখে বলে, তুই কিছু ভাবছিস বাবা? এখানে চুপচাপ দাড়িয়ে আছিস যে। রবিন মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওমা আমি কোন কিছুই ভাবছি না। মা, আমাকে লালন পালন করতে গিয়ে কতই না কষ্ট করতে হয়েছে তোমাকে।
ধুর বোকা। মার কাছে ছেলে মেয়ে লালন পালন করতে কোন কষ্ট হয়? এ যে মার কাছে পরম সুখ। আমি বেশ ভালো আছি তোকে নিয়ে।
রবিন বলল, মা তুমি সুখে না থেকেও বলো যে ভালো আছি। তোমার মত কতজন বলতে পারে আমি সুখে আছি। মা তুমি যে আমার পৃথিবীর সুখ। যেদিকে তাকাই শুধু তুমি ‘মা’।
ওরে আমার খোকন সোনা বলে কী!
মা তুমি যদি এ চাকরিটা না করতে তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম? শাহানা বলল, আল্লাহ আমাদের কোন এক ব্যাবস্থা করে দিতেন। যেমন এখন আমার সেই ছোট্ট ছেলেটা, হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ এইচএসসিতে পড়ে।
ঠিক আছে মা এখন আর দেরি করব না, আমার কলেজে যাওয়ার সময় হয়েছে।
ঠিক আছে, বাবা দেখে শুনে যাও।
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রবিন বলে, ঠিক আছে মা।
রবিন খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে। ক্লাসে সে সবসময় শান্ত হয়ে থাকে। কলেজে কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কেউ কোন কথা জিজ্ঞেস করলে তার কথায় উত্তর দেয়। নিজ থেকে কোন কথা বলে না। কলেজে তার তেমন একটা বন্ধু বান্ধবী নেই। তার একটাই মনের মধ্যে ধারণা— পড়ালেখা ভালোভাবে করতে হবে। সে একজন মেধাবী ছাত্র। জীবনে একটা কিছু করতে হবে। মাকে ছাড়া সে কাউকে চেনে না। এমন কী নিজের কোন আত্মীয়—স্বজনকেও না। তার মা তাকে নিয়ে কখনো কারও কাছে যায়নি। কারণ নিজের স্বামীকে সে কখনো ছোট করতে চায়নি। এর সমাধান তো কেউ দিতে পারবে না। তাই নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে।
কলেজে একটি মেয়ে সব সময় রবিনকে অনুসরণ করে। নাম তার রেমা। রেমা ভাবে, ছেলেটি কেন এত চুপচাপ? কারো সাথে কথা বলে না। ওর সাথে কেন আমার কথা বলার জন্য মন উত্তাল হয়ে থাকে? ওর সাথে আজ আমি কথা বলব। রেমা তার বান্ধবী অনাকে বলে, অনা শোন্। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।
কার সাথে? ওই যে ওর সাথে।
কি বলছিস, কার সাথে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ওই যে ওই ছেলেটার সাথে, ক্লাসে শান্ত হয়ে বসে থাকে। কারো সাথে কোন কথা বলে না।
আরে ও কোন কথা বলতে পারে না শুধু পড়ালেখা ছাড়া। আমার মনে হয় ও কথাই জানে না।
তুই যে কী বলছিস না, চল ওর সাথে কথা বলি।
আমি না, তুই যা। তুই গিয়ে যা বলার বল।
চল না, এমন করিস কেন?
গুটি গুটি পায়ে দুই বান্ধবী রবিনের পাশে গিয়ে বসল। রবিন কিছুই বলছে না। একটু নড়েচড়ে সরে বসে। রেমা বলে, আচ্ছা বলুন তো, আপনি এমন গম্ভীর হয়ে থাকেন কেন? রবিন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কী, কোন কথাই বলছেন না যে।
আমার একা থাকতে ভালো লাগে।
ঠিক আছে, কিন্তু আমরা এখানে যারা ক্লাসে আছি সবাই সবার বন্ধু। আমার পড়ালেখার কোন ব্যাপারে কথা বলতে পারি?
আমার সব ব্যাপারে নিজেকে একা রাখতে ভালো লাগে।
ভালো স্টুডেন্ট বলে?
থাক না বেচারা একা থাকতে চায় একা থাকতে দে। অনা বলল।
না আমি ওকে একা থাকতে দিবো না।
একথা শুনে রবিন হেসে দিলো।
হাসলেন কেন, আমার কথায় হাসি পায়?
গায়ে পড়ে কথা বলা আমার একদম ভালো লাগে না।
রবিনের কথা শুনে রেমা খুব ক্ষেপে গেল। বলল, আমি আপনার সাথে কথা বলছি। গায়ে পড়ে কথা বলছি, মোটেও তা নয়। আপনার মতো এমন গম্ভীর লোক কোথাও দেখিনি। উল্লুক নিজে কথা বলতে জানে না তাতো বলবে না। শুনুন, আমি কিন্তু আপনার প্রতি ক্ষেপে গেছি, আমার রাগ হচ্ছে আপানার প্রতি।
শুনলাম তো। বলা শেষ হয়েছে?
হঁ্যা, শেষ হয়েছে।
এবার তাহলে ক্লাসে গিয়ে বেঞ্চে বসুন।
আমি আমার বেঞ্চে গিয়ে বসবো, কিন্তু আপনার চোখের আড়ালে।
হঁ্যা তাই করেন।
শুনুন, চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হওয়া যায় না, বুঝেছেন?
রবিন মাথা নাড়ল। ক্লাসশেষে বাসায় ফিরে এলো রবিন। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা যতক্ষণ তোমার সামনে থাকি মনে হয় পৃথিবী আমার কাছে, আর যখন তোমার আড়ালে থাকি মনে হয় সবকিছুই যে আমার অন্ধকার।
শাহানা বলল, পাগল ছেলে আমার। আয়, তোর হাত মুখ ধুয়ে দেই। খেতে হবে তো, ক্ষুধা লাগছে না?
মা, আমি এখনো কি ছোট নাকি? বড় হয়েছি না? আমি তোমার ইন্টারে পড়া ছেলে, এখন কেন তোমাকে আমার হাত মুখ ধুয়ে দিতে হবে।
ও আমি তো ভুলে গেছি, ছেলে আমার বড় হয়েছে। তারপরও মায়ের কাছে সন্তান ছোটই থাকে বাবা।
ঠিক আছে মা, আমি তোমার স্নেহের স্থানে ছোট বাবু হয়ে থাকতে চাই। শাহানা ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো তোকে বুকে নিয়েই তো বেঁচে আছি বাবা। তোর বাবা ছেলে জন্ম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছেলের দায়িত্ব তো পালন করেনি। মানুষের স্বার্থপর ভালোবাসা মানুষকে কত দূর নিয়ে যায়! ভুলিয়ে দেয় তার জীবনের অন্য কোন সম্পর্কের কথা। হায়রে মানুষ! তোকে বোঝা দায়। ভাবতে ভাবতে শাহানা স্মৃতির গহীনে হারিয়ে যায়। ছেলের কথা ভুলে যায়। রবিন বলে, মা বসে চুপ হয়ে আছ যে?
ও, বাবা তুই কিছু বলছিস?
মা, তুমি কিছু ভাবছ?
নারে বাবা, চল খাবি।
মা ছেলে এক সাথে খেয়ে নেয়। রবিন মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, মা বাবা তো তার ছেলের খেঁাজ না নিয়ে পারল। মা, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারলে না। যেখানে আছো আমাকে নিয়েই আছো।
কেন বাবার কথা মনে পড়ছে?
না মা, তা পড়ছে না। মনে হলো বাবা তার সন্তানের খেঁাজ না রেখেও পারে, কিন্তু মা পারে না।
মায়ের যে নাড়িছেঁড়া ধন, সে কি পারে? তবু আমি তো সব দিতে পারলেও বাবার পূর্ণতা দিতে পারছি নারে।
না মা, তা নয়। তোমার মতো এত ভালোবাসা বাবা কি দিতে পারত? পারতো সে আমায় নিয়ে একা থাকতে? আর কোন প্রকৃত বাবাই পারে না তার সন্তানকে রেখে দূরে থাকতে।
সবাই নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে অন্যের জন্য কিছু করতে পারে না, সেও হয় তো পারছে না। যদি তোমার বাবার কথা মনে পড়ে তাহলে যাও বাবার সাথে গিয়ে দেখা করো।
মা, যে বাবা নিজে সন্তানের ভুলে থাকতে পারে তার সাথে আমার দেখা করেই বা কী হবে? সে তার মতো করে থাক।
আমার যতটুকু করার আমি ততটুকু করতে পারি। অন্যের মনের উপর তো জোর খাটাতে পারি না। তাও যদি পারতাম আমি তোর জন্য করতাম।
মা, তুমি আমার জন্য কী না করেছ? আমি চাই না এমন বাবাকে।
পরের দিন রবিন কলেজে এলে তাকে দেখে রেমা বলল, আজ দেখি তুমি কীভাবে নীরব থাকো, আমি তোমাকে নীরব থাকতে দিচ্ছি না। রেমা স্যারের কাছে গিয়ে বলে, স্যার, আমি একটা কথা বলতে চাই।
বলো কী বলতে চাও?
স্যার, আমাদের কলেজের খেলায় সবাই কমবেশি অংশগ্রহণ করে, কিন্তু রবিন করে না। ওকে আপনি বলে যদি কোন খেলায় অংশগ্রহণ করাতেন।
দেখো, খেলা হচ্ছে মনের আনন্দ। এখানে যার ইচ্ছা সে খেলবে, যার ইচ্ছা সে খেলবে না।
স্যার, তারপরও আপনি যদি বলতেন।
আচ্ছা, আমি দেখবো— বলে স্যার রবিনকে ডাকলেন। রেমা অনেক খুশি এবার। রবিনকে দেখে হাসতে লাগল।
স্যার, আমাকে ডেকেছেন?
হঁ্যা রবিন, আমি তোমাকে যে জন্য ডেকেছি— আমাদের কলেজে খেলা চলছে। আমি চাই, তুমি তার মধ্যে যে কোন খেলায় অংশ নাও।
স্যার, আমি এ পর্যন্ত স্কুল—কলেজের কোন খেলায়ই অংশগ্রহণ করিনি।
যা এতদিন করোনি তা এখন করবে। আর করোনি বলে এখন করবে না তা কি হয়?
স্যার, আমার দ্বারা খেলাধুলা হবে না।
সবার দ্বারা সবকিছু সম্ভব যদি তার ইচ্ছা ও মনোবল থাকে। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।
রেমা মুখ খিঁচিয়ে ভেংচালো। তারপর নাকের উপর হাত দিয়ে ডলা দিল। রবিন তা লক্ষ্য করল। তারপর বলল, স্যার আমি খেলব।
আমি বললাম, তুমি পারবে। তুমি নিজের প্রতি আস্থা রাখো। প্রতিটি মানুষ যদি তার নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারে তাহলে সে যেটাই চায় তা তার সেটা পাওয়া সম্ভব।
রবিন কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দুটি খেলায় অংশগ্রহণ করতে নাম লেখায়। দৌড় আর বালিশ খেলা। আগে কখনো খেলেনি। তাই মনে একটু ভয় পাচ্ছিল। রেমার রহস্যময় হাসির কারণে রবিনের মনে জেদ চাপল।
রবিনের ব্রতঃ আমার এ খেলায় জিততে হবে। তারপর সে পুরোদমে প্রাকটিস শুরু করল। রেমা বলল, আমি তোমার সাথে বালিশ খেলায় অংশগ্রহণ করতে চাই। বালিশ খেলায় ছেলে মেয়ে উভয়ে অংশ নিতে পারে। রবিন বলল, আমি তোমার সাথে খেলতে চাই না। রেমা বলল, তুমি আমার সাথে খেলায় পারবে না। রবিন বলল, তোমার খেঁাচা মেরে কথা বলার অভ্যেসটা একটু বেশি, ঠিক আছে আমি তোমার সাথে খেলব।
যাক, শেষমেষ রাজি হলে।
তোমার কথা কেমন যেন লবণের ছিটার মতো।
যাক—বুঝলে ভালো, না বুঝলেও ভালো।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি তোমার পথে যাও, আমি আমার পথে।
রেমা রবিনের কানের কাছে গিয়ে বলল, তুমি যা—ই বলো না কেন আমাদের দুজনের পথ কিন্তু একটাই হবে।
তুমি মেয়েটা যে কী! একেবারে অসহ্য!
কেন, আমার জ্বালা বুঝি সহ্য করা যায় না?
একদম না।
তর্কশেষে দুজন দুদিকে চলে গেল।
সম্পাদক ও প্রকাশক
এ এম জি ফেরদৌস
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
নাহিদুল ফাহিম
প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা
ইঞ্জি. মেহেদী হাসান |
প্রধান কার্যালয়
পূর্ব লিংক রোড, ঝিরংঝা, কক্সবাজার
মোবাইল: ০১৮১৯-৫০২-৩২২
ই-মেইল beachnews247@gmail.com |
প্রিন্টের তারিখ ও সময়: December 11, 2024, 8:54 pm