কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচন : যে কারণে মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর পরাজয়

তোফায়েল আহমদ

  বিশেষ প্রতিনিধি    18-10-2022    179
কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচন : যে কারণে মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর পরাজয়

কক্সবাজার জেলা পরিষদের গতকাল সোমবারের অনুষ্টিত নির্বাচনে ১৮৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন পরিষদের সাবেক প্রশাসক ও চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী। অপরদিকে এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহ সভাপতি শাহীনুর হক মার্শাল। নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী শাহীনূল হক মাশার্ল পেয়েছেন ৫৭৮ ভোট এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরী পেয়েছেন ৩৯৫ ভোট। নির্বাচনে জয়—পরাজয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কেন ভোটের ফলাফল এরকম ব্যবধান হল ? কেন অমুক প্রার্থী জিতলেন এবং অমুক হারলেন ? কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এবার জমজমাট প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্টিত হয়েছে। আলোচিত দুই প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থীই বলতে গেলে একই রাজনৈতিক মতাদর্শের হলেও ব্যবধান হচ্ছে একজন দীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ভরপুর বর্ষিয়ান রাজনীতিক সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী অপরজন নবচেতনায় উদ্বেলিত তারুণ্যের প্রতীক এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহীনুল হক মাশার্ল। এক চমৎকার নির্বাচনী পরিবেশে অনুষ্টিত নির্বাচনে তারুণ্যের প্রতীক শাহীনুল হক মাশার্লকে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা শেষ পর্যন্ত জেলা পরিষদের মত একটি ‘খান্দানী জনপরিষদের’ (জেলা পরিষদ) চেয়ারমান হিসাবে বাছাই করে নিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে অত্যন্ত সন্মানী চেয়ারটি হচ্ছে এটি। কেবল মোস্তাক আহমদ চৌধুরী একজন জীবন সায়াহ্নের মানুষ বলেই কি ভোটারদের কাছে তিনি ‘অযোগ্য’ হলেন? কক্সবাজারের চৌফলদন্ডির জমিদার বিখ্যাত খান বাহাদুর পরিবারের একমাত্র উত্তরসুরি জনাব চৌধুরী সারাজীবন পিতা আর পিতামহের জমিদারি বিক্রির টাকা ঢেলেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য। শেষ বয়সে তিনি এমন পরাজয়টা পেলেন ? এমন প্রশ্নের জবাব খঁুজতে গিয়ে অনেকগুলো কথার সন্ধান মিলেছে। তবে এসবেরও পক্ষে—বিপক্ষে থাকে নানা কথা। বলা হচ্ছে, সোমবারের নির্বাচনে কেবল ব্যক্তি বাছাই হয়নি। হয়েছে সুপরিকল্পিত এবং সুনিদ্দির্ষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ফর্মুলাও। সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্যটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলীয় নেতৃত্বের কোন্দল। যেখানে ছিল ‘মুখে মিষ্টি অন্তরে বিষ’। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চলমান কোন্দল এমনই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দলের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট জা্হা্ঙ্গীর কবির নানকের মত দলের ডাকসাইটে নেতা এসে পর্যন্ত কোন কুল কিনারা করতে পারেন নি। যেহেতু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। তাই দলের মধ্যে দীর্ঘকালের চলমান নেতৃত্বের কোন্দলটি এমনই ছিল যে, অমুক আমার প্রতিপক্ষ তাই উনি যার পক্ষে আমি তার পক্ষে নেই ভাবখানাটি সুপরিকল্পিত ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দলীয় কোন্দলের টার্গেট হচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগের আসন্ন কমিটি সহ দলের পরবর্তী সবগুলো কমিটি বাগিয়ে নেওয়া। এখন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বুঝানোর চেষ্টা হবে এবং উল্টো অভিযোগ করা যাবে—জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কারণেই দলীয় সভানেত্রীর মনোনীত প্রার্থী হেরে গেছেন। আবার এমনও কথা উঠেছে যে, কক্সবাজার জেলার ৭১ টি ইউনিয়ন এবং ৪ টি পৌরসভায় নির্বাচিত কাউন্সিলার ও মেম্বারগণের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সংখ্যা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলীয় আদর্শ লালন করা লোকজন। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন্দলে সম্পৃত্ত নেতাদের যোগসাজসে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে আনন্দ—উচ্ছাসে গা ভাসিয়েছেন। এখন সরকার বিরোধীরাই আওয়াজ তুলবেন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়—তার প্রমাণ কক্সবাজারে শেখ হাসিনার প্রার্থীর ভরাডুবি। বর্তমানে উপজেলা—ইউনিয়নের স্থানীয় সরকারের নীতিমালাটি যে পদ্ধতির তাতে কোন তৃণমূল প্রতিনিধির স্ব স্ব সংসদীয় আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যের হুকুমের বাইরে যাবার কোন সুযোগই নেই। একজন সংসদ সদস্যের সুপারিশ ছাড়া এলাকার ছোটখাট যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা চিন্তাও করা যায়না। তাই জেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের ভুমিকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে দলের অভ্যন্তরে দলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্যের ভুমিকা নিয়েও এখন আলোচনা হচ্ছে। যদিওবা প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জেলা পরিষদ সমূহে দেশব্যাপি বয়োজ্যষ্ঠ নেতাদের প্রাধান্য দিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন—‘ এসব বয়োজেষ্ঠরা দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগ ধরে আছেন। তারাই মুক্তিযুদ্ধে ভুমিকা রেখেছেন। তারাই জাতির জনকের তৃণমুলের খঁুটি ছিলেন। তাদের শেষ বারের মত মূল্যায়ণ করা হচ্ছে।’ তারপরেও কক্সবাজারের জেলা পরিষদে গত এক দশক ধরে মোস্তাক আহমদ চৌধুরী প্রশাসক ও চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতাকালীন সময়ে এমন দৃশ্যমান কাজ করা হয়নি যা এবারের নির্বাচনে ভূমিকা রাখার মত। তেমনি মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে জনসম্পৃত্তহীনতারও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে এবারের নির্বাচনে। তাঁর সাথে তৃনমূলের চেয়ারম্যান—মেম্বারদের তেমন পরিচিতি নেই। তিনি অত্যন্ত অমায়িক ও ভদ্র মানুষের একজন জীবন্ত প্রতীক—এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী লীগের জন্য সারা জীবন তিনি কেবল দিয়েছেন। তিনি এমপি ছিলেন, ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়কও। তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক অবদানের কোন কমতি নেই। কমতির অভিযোগ কেবল লোকজন তথা জনপ্রতিনিধিদের সাথে জনসম্পৃত্ততা নিয়ে। আরো অভিযোগ এবারের নির্বাচনে তিনি কেবল দলের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। অন্তকোন্দলের দলে এটি যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মত আরো গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোটার তথা জনপ্রতিনিধিদের দুয়ারে ছিলেন তিনি অনুপস্থিত। অপরদিকে টগবগে তরুণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহ সভাপতি শাহীনুল হক মার্শাল একজন উঠতি ব্যবসায়ী। কক্সবাজার পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং দীর্ঘকালীন সময়ের জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম মোজাম্মেল হকের সন্তান বলেও কথা। যেখানেই গেছেন মানুষ মোজাম্মেল পরিবারের সন্তান হিসাবে অত্যন্ত আদর—স্নেহ নিয়ে কদর করেছেন। একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির বিপরীতে ‘ডিজিটাল যুগের’ এই তরুণ ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গেছেন একাধিকবার। সেই সাথে তারুণ্যেরও জোয়ার সৃষ্টি করেছেন তিনি। নির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহীনুল হক মার্শালের স্বল্পসময়ে এমন জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধানে যেটা উল্লেখযোগ্য হিসাবে জানা গেছে, সেটি হচ্ছে এলাকার এসময়কালে নির্বাচিত চেয়ারম্যান—মেম্বারগণও বেশির ভাগ হচ্ছেন তরুণ। বড়জোর ৫০ এর নিচে বয়স তাদের। তাই শাহীনুল হক মার্শালের সাথে তৃণমূলের তারুণ্যের জনপ্রতিনিধিরা অতি সহজেই মিশে গেছেন। অপরদিকে সত্তরোর্ধ বয়সের কোঠায় থাকা বয়োজেষ্ঠ নেতা ‘এনালগ যুগের মানুষ’ মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর সাথে এখনকার তৃণমূল জনপ্রতিনিধিদের বয়সের ফারাকটিও রয়েছে অনেক তফাৎ। যার কারণে মেলামেশার বিষয়টিও ছিল বলতে গেলে একটু ব্যবধান। তবে নির্বাচনী বাজারে যে কথাটি না বললেও নয়—সেটি হচ্ছে প্রচুর টাকারও মোলাকাত হয়েছে। যে টাকা নিয়ে ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়েছে প্রচুর লেখালেখিও। আবার নির্বাচনকে উপলক্ষ করে ভোটারদের পাহাড়ী পিকনিকে পর্যন্ত মাতিয়ে তোলা হয়েছে। লেখক : বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কন্ঠ।

মুক্তমত-এর আরও খবর