আসছে নতুন মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি কি নিয়ন্ত্রণে আসবে?

  বিশেষ প্রতিনিধি    05-01-2023    133
আসছে নতুন মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি কি নিয়ন্ত্রণে আসবে?

এই মুহূর্তে দেশের সাধারণত মানুষকে নাজেহাল করছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তাই এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আর কোনও কিছুই ভাবছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ভাবনা থেকে একাধিকবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া আরও যে সব কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাও নিয়েছে। তবু অধিকাংশ জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আসছে নতুন মুদ্রানীতি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আসন্ন মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কী করলে জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রাকে স্থিতিশীল করতে বিশেষ গুরুত্ব থাকবে নতুন মুদ্রানীতিতে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাকি ছয় মাসের নতুন মুদ্রানীতি আগামী ১৫ জানুয়ারি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন খাতে তারল্য সাপ্লাই বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রেটকে স্থিতিশীল করতে এক্সপোর্ট প্রসিড ও রেমিট্যান্স রেট সমন্বয়ের জন্য মুদ্রানীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দিবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার পূর্বে দ্বিতীয় সমন্বয় সভা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারে সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নির্বাহী পরিচালক ও ডিপুটি গভর্নররা এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় কয়েকজন নির্বাহী পরিচালক মূল্যস্ফীতি কমাতে রেপো ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়াতে বলেছেন। এর আগে ৫ ডিসেম্বর দেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

আগামী ৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে রাজধানীর একটি হোটেলে এই মুদ্রানীতির সর্বশেষ বৈঠক করবেন।

কোভিডের আগে ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা হতো। কোভিডের কারণে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতি এক বছরের জন্য করা হয়।

তবে এবার আগের মতো বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়ে ছয় মাসের মুদ্রানীতি করার কথা বলেছিল। সেটির আলোকেই আগামী জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা হবে।

সাধারণত মুদ্রার গতিবিধি প্রক্ষেপণ করে এই মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতির অন্যতম কাজগুলো হলো—মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা, ঋণের প্রক্ষেপণের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি ঋণের জোগান ধার্য করা এবং মুদ্রার প্রচলন নিয়ন্ত্রণ করা।

এদিকে নতুন মুদ্রানীতি আসার আগেই অন্তত তিনবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে রেপো সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে রেপো সুদহার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য রেপো সুদহার বাড়ানো হয়েছে।

মূলত, মুদ্রানীতির অনুযায়ী মূলত ঋণের প্রাপ্যতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্প মেয়াদে ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পতনের পরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা এখনও বিদ্যমান। কারণ চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন সমস্যা আরও খারাপ হয়েছে। এর ফলে ২০২১ সালের শুরু থেকে বিশ্ববাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগত সুদের হার বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকও একই পথে হাঁটতে চাইছে।

সাধারণত ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার নেয়, তাই রেপো নামে পরিচিত। এই রেপো সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত টাকার প্রবাহ কমাতে, যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে, এটাই এ সিদ্ধান্তের মূল কারণ।

তবে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দিচ্ছে, সেটির বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকগুলো বেশি সুদে টাকা ধার করলেও ঋণের সুদ বাড়াতে পারবে না। এর ফলে ব্যাংক টাকা ধার নেওয়া কমাবে, ঋণও কম দেবে। এ কারণে এ সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত ২৯ জুন রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২৯ মে বাড়ানো হয়েছিল ৫০ বেসিস পয়েন্ট। রেপো সুদহার বাড়লেও রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। রিভার্স রেপো হলো ব্যাংকের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার সুদহার।

এদিকে গত ২০ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল হয়েছে। সেখানে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫.৬% থেকে বাড়িয়ে ৭.৫% নির্ধারণ করেছে। একইসঙ্গে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৫% করা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে বিষয়টি তুলে ধরা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধির তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে।

গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ৭.৩৫। যদিও একইসময়ে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১৪%।

এর ফলে দেশের ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য মাত্র তিন মাসে ৩৩,০০০ কোটি টাকা কমে সেপ্টেম্বরে ১.৭০ লাখ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

অর্থ-বাণিজ্য-এর আরও খবর