পশ্চিমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গেই ইউক্রেন যুদ্ধ

  বিশেষ প্রতিনিধি    14-01-2023    170
পশ্চিমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গেই ইউক্রেন যুদ্ধ

বিল ক্লিনটন, টনি ব্লেয়ার ও ভ্লাদিমির পুতিন

ইউক্রেন-রাশিয়ায় চলছে সামরিক সংঘাত। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বলছে, এটি ইউক্রেনে রুশ ‘আগ্রাসন’। রাশিয়া বলছে, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান।’ আগ্রাসন কিংবা অভিযান যাই বলা হোক, ইউক্রেন-রাশিয়ার সামরিক সংঘাত পরিণত হয়েছে যুদ্ধে। সব কিছুর মতো এরও রয়েছে কার্যকারণ, প্রেক্ষাপট। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকারের একটি ডিক্লাসিফাইড নথিতে প্রকাশ পেয়েছে সেই সূত্র। অন্যান্য তথ্য ঘেঁটে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন দৈনিক আমাদের সময়-এর সহযোগী সম্পাদক প্রমিত হোসেন

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যাদের জানা নেই, পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের প্রতিধ্বনি করে তারা বলবেন- এটা রুশ আগ্রাসন। সেই প্রেক্ষাপটটা কী?

স্পুৎনিক ইন্টারন্যাশনাল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, গত ২৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকারের একটি গোপন নথি প্রকাশ করে দেশটির ন্যাশনাল আর্কাইভ। ২০০০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তৎকালীন টনি ব্লেয়ার সরকারের মন্ত্রিসভার কাগজপত্রও নথিতে যুক্ত করা হয়েছে। ডিক্লাসিফাইড সেই নথিতে উল্লেখ করা হয়, ঠাণ্ডাযুদ্ধোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাশিয়াকে ‘সভ্য জগতের’ অংশীদার করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। নতুন করে পাওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ‘ভালো সম্পর্ক’ সন্ধান করছিল রাশিয়া, সেই ভালো সম্পর্কও বজায় রাখা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমারা রক্ষা করেনি নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি। ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনটন প্রশাসন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো সম্প্রসারণের মাধ্যমে।

১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানি আবার পরিণত হয় এক রাষ্ট্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে। জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের ব্যাপারে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করে, পুনরেকত্রিত জার্মানির পূর্ব দিকে ‘এক ইঞ্চিও’ অগ্রসর হবে না ন্যাটো। সেই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে দুই জার্মানির একত্রীকরণ মেনে নিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ।

এ ব্যাপারে গর্বাচেভ যে ভুল করেছিলেন, তা জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী অর্থমন্ত্রী পল ক্রেইগ রবার্টসের কথায়। গত ৩১ আগস্ট ওয়াশিংটনে সংবাদমাধ্যম স্পুৎনিককে তিনি বলেন, গর্বাচেভকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো আর সম্প্রসারিত হবে না। গর্বাচেভ সেটা বিশ্বাস করেছিলেন এবং সেটাই ছিল তার ভুল। তিনি ওয়াশিংটনের মতলব বুঝতে পারেননি।

পল রবার্টস বলেন, ‘একটি প্রকৃত ঘটনা আমি খুব ভালো করেই জানি, (তৎকালীন মার্কিন) পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার গর্বাচেভকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, গর্বাচেভ জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের অনুমতি দিলে ন্যাটো পূর্বদিকে এক ইঞ্চিও অগ্রসর হবে না। বেকার এ কথা বলেছিলেন, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যদিও নব্যরক্ষণশীল মার্কিনরা ও ক্লিনটন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এটা অস্বীকার করে এসেছে।’

পশ্চিমারা সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ১৯৯৯ সালে পোল্যান্ডকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সে বছরই চেক প্রজাতন্ত্র ও হাঙ্গেরিকেও ন্যাটোভুক্ত করা হয়। পূর্ব ইউরোপের এসব দেশ আগে ছিল ন্যাটোর প্রতিপক্ষ সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোটের সদস্য। এখানেই থামেনি ন্যাটো। সে সময় স্লোকভাকিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া, এস্তোনিয়া, লাৎভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকেও নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার আলোচনা চালাচ্ছিল ন্যাটো। কৌশলগতভাবে এর ফলে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর সেন্ট পিটার্সবুর্গ মাত্র ১০০ কিলোমিটার ব্যবধানে নাগালের মধ্যে চলে আসত ন্যাটোর। পরবর্তী সময়ে সেটাই ঘটেছে। এসব দেশ চলে যায় ন্যাটোর পেটে।

ব্রিটিশ সরকারের প্রকাশিত গোপন নথিতে বলা হয়েছে, ব্লেয়ার সরকারের আমলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন ইগর সের্গেয়েভ। ২০০১ সালেই সের্গেয়েভ সতর্ক করে বলেছিলেন, পূর্বদিকে ন্যাটোর অব্যাহত সম্প্রসারণ ‘গুরুতর রাজনৈতিক ভুল’ এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ‘উপযুক্ত পদক্ষেপ’ নিতে বাধ্য হবে মস্কো।

এর পর ন্যাটো যখন হাত বাড়ায় ইউক্রেনের দিকে, তখনই দেখা দেয় মস্কোর প্রতিক্রিয়া। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয় রুশ বাহিনী। ঐতিহাসিকভাবে এ উপদ্বীপটি ছিল রাশিয়ার ভূখণ্ড। অবিভক্ত সোভিয়েত আমলে এটি ন্যস্ত করা হয়েছিল ইউক্রেন অঙ্গ-প্রজাতন্ত্রের কাছে, এটি কোনোভাবেই ইউক্রেনি ভূখণ্ড নয়। সুতরাং ইউক্রেনের ভূখণ্ড দেখিয়ে সেটিকে রাশিয়া জোর করে দখল করেছে বলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যা প্রচার করে তা সত্য নয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পরও দীর্ঘকাল এটি ফেরত চায়নি রাশিয়া। তা হলে ২০১৪ সালে আচমকা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কারণ কী?

এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বক্তব্যে। ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, জাতির উদ্দেশে এক টেলিভিশন ভাষণে পুতিন বলেছেন, ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল বন্দর নগরী রাশিয়ার নৌবাহিনীর গৌরব। সেখানে ‘ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ ঘাঁটি গেড়ে বসত’ যদি রাশিয়া ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ না করত। পুতিন সেখানে রুশ বাহিনী মোতায়েন করতে দুদিন দেরি করলেই এমন ঘটনা ঘটে যেত বলে তার কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল। সুতরাং ক্রিমিয়া ‘দখল’ শুধুই ক্রিমিয়া দখল নয়, তা স্পষ্ট। এসব তথ্য নিজেদের স্বার্থেই চেপে গেছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম।

এর পর দেখা দেয় রাশিয়ার দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া। এ দফায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এ অভিযান শুরুর আগে ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করতে সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে নিয়েছিল ন্যাটো। রাশিয়া সেটার বিরুদ্ধে ‘উপযুক্ত পদক্ষেপ’ নিতে শুরু করে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান।’

এটাই হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধের নেপথ্যের কারণ। রুশ অভিযান শুরুর দুদিন আগে ২২ ফেব্রুয়ারি এক টুইটে মার্কিন রক্ষণশীল রাজনৈতিক ভাষ্যকার ক্যান্ডেস ওয়েন্স লেখেন, ‘ন্যাটো (যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায়) আগের চুক্তি লঙ্ঘন করছে এবং পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে।’ ইউক্রেন ঘিরে ‘প্রকৃত কী ঘটছে’ তা তিনি তুলে ধরেন।

২০০১ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জন সয়ার্স একটি সিকিউরিটি পেপার প্রস্তুত করেন ব্লেয়ারের জন্য। পুতিন প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ন্যাটোবিরোধী’ ছিলেন না, সে তথ্য বিকৃত করেছিলেন সয়ার্স ওই পেপারে। পুতিনের ‘গঠনমূলক’ বিবৃতিও অগ্রাহ্য করেন তিনি। বরং দোষ চাপিয়ে দেন রাশিয়ান ইন্টেলিজেন্সের ঘাড়ে। এসব তথ্য উন্মোচিত হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রতিক ডিক্লাসিফাইড নথিতে।

ওই নথিতে আরও প্রকাশ, পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য যাচাই করতে চেয়েছিলেন পুতিন ২০০০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনকে তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া স্বয়ং ন্যাটোতে যোগ দিতে চায়। সে কথা স্মরণ করে ২০১৭ সালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার অলিভার স্টোনকে পুতিন বলেছিলেন, ‘মস্কোয় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাতের কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, রাশিয়াও যাতে ন্যাটোতে যোগ দিতে পারে সে সুযোগ আমাদের বিবেচনা করা উচিত। ক্লিনটন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন নয়?’ কিন্তু মার্কিন প্রতিনিধিদল অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।’

১৯৫৪ সালেও তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিয়াচেস্লোভ মলোতভ ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল ন্যাটো। এর এক বছর পরই গঠিত হয়েছিল ওয়ারশ চুক্তির জোট। এর ফলে ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল পরবর্তী সাড়ে তিন দশক। সেই নিরাপত্তার ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে বর্তমানে এসে। ঠাণ্ডাযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে।

আন্তর্জাতিক-এর আরও খবর