রমজানে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত লাভের কৌশল নিয়ে ইসলামে হুঁশিয়ারি

বেলায়েত হুসাইন

  বিশেষ প্রতিনিধি    28-02-2023    200
রমজানে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত লাভের কৌশল নিয়ে ইসলামে হুঁশিয়ারি

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত অর্থাৎ দয়া, ক্ষমা ও মুক্তি—মূল্যবান এই তিনটি বিষয়ের বার্তা নিয়ে আগমন করে পবিত্র মাস রমজান। সারা বছর পাপে ডুবে থাকা বান্দা এ মাসে স্বীয় প্রতিপালকের কতটুকু রহমত, মাগফিরাত অর্জন করতে পারলো এবং সর্বোপরি জাহান্নাম থেকে নাজাত পেলো কিনা—এ চিন্তায় বিভোর থাকে সে।

রমজান দরজায় কড়া নাড়ার আগেই রজব ও শাবান মাসে রমজানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বান্দা। উদ্দেশ্য একটাই—বছরজুড়ে পৃথিবীতে কামাইয়ে ব্যস্ত থাকলেও রমজানে আখিরাতের পুঁজি সংগ্রহে মনোনিবেশ করা। কারণ এ মাসে পুণ্যের কাজে অনেক বেশি পরিমাণ সওয়াব লাভ হয়।

হাদিস শরিফে এসেছে—রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করলো সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করলো। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলো সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করলো। (শুআবুল ঈমান : ৩/৩০৫-৩০৬)

ব্যবসায়ীদের একটি বিশেষ মৌসুম থাকে যখন তাদের ব্যবসা হয় খুব জমজমাট ও লাভজনক। রমজান মাসও আখিরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য মৃত্যুপরবর্তী জীবনের পুঁজি সংগ্রহের উত্তম মৌসুম। হাদিসের ভাষ্য থেকে অন্তত এটিই বোঝা যায়। মানে রমজান আসলে মানুষ ধর্মেকর্মে বেশি মনোযোগী হবে এবং পার্থিব জীবনের ওপর আখিরাতকে প্রাধান্য দিয়ে বেশি বেশি সওয়াব লাভে ব্রতী হবে।

আমাদের দেশে এই দৃশ্য এখনও কমবেশি দেখা যায় কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে ঢের; রমজান আসলে আমাদের দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা মনে করেন—রমজান মাস মূলত কামানোর সুবর্ণ সুযোগ ও মোক্ষম সময়। তারা এ মাসে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়িয়ে দেন এবং অধিক মুনাফা লাভের প্রয়াসী হন।

রমজানে বেশকিছু পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। পানীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, ছোলা, চিনি, আটা ইত্যাদির সঙ্গে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের দামও রমজানে বেড়ে যায়। সারা বছর যারা শাকাহারী থাকেন, তারা অন্তত রমজান মাসে পাতে একটু মাছ, মাংস ইত্যাদি রাখতে চান। আর এই সুযোগই কাজে লাগান ওই ব্যবসায়ীরা। একে তো মানুষের চাহিদা, অন্যদিকে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেন তারা। এর মাধ্যমে পণ্যের চাহিদাকে আরও ব্যাপকতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, ফলে বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে তৈরি হয় একপ্রকার প্রতিযোগিতা। এটিকেই লুফে নিয়ে চড়া দাম হাঁকিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করতে থাকেন। অথচ এরূপ পণ্য মজুত করার মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়ানোতে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

হাদিস শরিফে এসেছে—রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জঘন্য অপরাধী ছাড়া কেউ-ই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (মূল্য বৃদ্ধির আশায়) মজুত করে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৪৭)

একইসঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য মজুত করে ও বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে, তাদের ওপর প্রিয়নবী (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, আমদানি পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুতদার অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৩) হজরত ওমর (রা.) আরও বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুত করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫) অন্যায্যভাবে এরকম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে হাদিস শরিফে আরও অসংখ্য হুঁশিয়ারি বর্ণিত হয়েছে।

রমজানে আরবের মুসলিম দেশগুলোতে দেখা যায়—এ মাসের আসল রূপ। সেখানে বরং তারা রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার যথাযথ চেষ্টা করেন। কারণ, সেখানকার ব্যবসায়ীরা এ মাসে তাদের ব্যবসাকে আখিরাতের পুঁজি সংগ্রহে কাজে লাগান। একে কেন্দ্র করে ব্যবসায় পার্থিব লাভের প্রতি মনোযোগী হন না। এ সময় রমজান ও ঈদ উপলক্ষে পণ্যের মূল্যে বিশেষ অফার ও ছাড়ও ঘোষণা করেন তারা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব বিষয় প্রকাশিতও হয়। কারণ, তারা বিশ্বাস করেন—মুমিনের কোনও কাজই অনর্থক নয়; নিয়ম মেনে করলে সব কাজই তার ইবাদত। ব্যবসাকেও তারা ইবাদত হিসেবে নেন। জনকল্যাণে যারা সৎভাবে ব্যবসা করেন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের বিশেষ সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবীরা, সিদ্দীকীন (সত্যবাদী) এবং শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (তিরমিজি : হাদিস ১২০৯)

অর্থাৎ সৎ ব্যবসায়ী কোরআন-হাদিসের আইন মেনে সঠিক পথে ব্যবসা করার কারণে সে কোনও গুনাহে লিপ্ত না হয়েই মুনাফা অর্জন করে। যা তার জন্য বরকতময় ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। আমাদের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী আছেন, তারাও যেন তাদের ব্যবসাকে স্রেফ ব্যবসা হিসেবে না নিয়ে বরং এটিকে ইবাদত ও জনগণের সেবা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কৌশলে দাম না বাড়িয়ে বরং সহনীয় পর্যায়ে পণ্যদ্রব্যের দাম কমিয়ে দিয়ে হালাল উপার্জনে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ব্যবসা-বাণিজ্যে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের তাওফিক দান করেন। আমিন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা

ধর্ম ও জীবন-এর আরও খবর