আধ্যাত্মিক নেয়ামত তাহাজ্জুদ

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

  বিশেষ প্রতিনিধি    07-04-2023    132
আধ্যাত্মিক নেয়ামত তাহাজ্জুদ

প্রত্যেক প্রাণী বা জীবের দেহ আছে প্রাণও আছে। দেহ ও প্রাণের সমন্বয়ে জীবন। দেহ না থাকলে প্রাণ থাকবে না। প্রাণ না থাকলে দেহ লাশে পরিণত হবে। তবে জীব হলেও দেহ ও প্রাণের অতিরিক্ত আরেকটি জিনিস আছে মানুষের, যার নাম আত্মা। আত্মার দুটি রূপ জীবাত্মা ও পরমাত্মা। অথবা বলব নফস ও রূহ। জীবাত্মা বা নফস দেহের জৈবিক চাহিদাগুলোর জোগান দেয়। আর রূহ মনুষ্যত্বকে লালন করে। এখানেই নফস ও রূহের মাঝে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পরমমাত্মা বা রূহ পরাজিত হলে কিংবা মরে গেলে মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়।

যুগে যুগে মহাপুরুষগণ এসেছেন মানুষের পরমাত্মাকে শক্তিশালী করার জন্য। নফস বা জীবাত্মাকে দমন করার জন্য নানা কৃচ্ছতা, সাধনা ও কসরত নির্দেশ করেছেন। তাদের নির্দেশনার মূল কথা পরমাত্মাকে শক্তিশালী করবার জন্য জীবাত্মকে দমন কর। দুনিয়া বিরাগী হও। দেহকে কষ্ট দিলে আত্মার উন্নতি হবে। খ্রিস্টান ধর্মে পাদ্রী বা সেইন্টদের বিবাহ বর্জনের দর্শনের উৎপত্তি এখান থেকে। বৌদ্ধ ধর্মে ভিক্ষুরা ভিক্ষার জীবনের মধ্যে আত্মার মুক্তি ও নির্বান সন্ধান করেন। হিন্দু ধর্মেও যোগী সন্যাসীরা কৃচ্ছ সাধনায় সন্যাস জীবনে আত্মার মুক্তি খোঁজেন।

ইসলামে বৈরাগ্যের দর্শন নেই। সংসার ত্যাগ বা দেহের চাহিদা সম্পূর্ণ বর্জনের বৈরাগ্য জীবন মানব স্বভাবের বিরুদ্ধ। নফসকে ধ্¦ংস নয়, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইসলামের মূল আবেদন সংসারী হও সংযমী হও, তাকওয়া অর্জন কর। সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন না হলে আত্মিক উন্নতি শুদ্ধ হবে না। এ জন্যে ইসলামের আত্মিক সাধনা বিশেষ পুরোহিত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এই সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে ও সফল হতে হবে। রমযানের রোযার কৃচ্ছসাধনা এবং তাতে সাফল্যের মহরত ঈদ তার একটি উদাহরণ।

বর্তমান ভোগবাদী সমাজে রূহানী উন্নতির বিষয়টি নিয়ে মুসলমানরাও চিন্তিত। এ জন্যে অনেকে পীর ফকিরীর জীবনে, মসজিদে চিল্লায় বা অস্বাভাবিক পন্থায় আত্মিক উন্নতি খোঁজ করেন। ইসলামী চেতনায় লালিত মুসলিম যুবকরা মনে করে, ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আত্মিক শক্তিতে বলিয়ান হতে হবে। কেবল জাগতিক শক্তি বা কলাকৌশল দিয়ে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। কিন্তু সেই আধ্যাত্মিক সাধনা ও সাফল্যের স্বাভাবিক পথটি খুঁজে পাই না আমরা। যদিও তা আমাদের সামনে সারা বছর উন্মুক্ত। পবিত্র রমযান মাস আমাদের সামনে সেই পথের পরিচয় নতুন করে তুলে ধরে।

রমযানে শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য আমরা ঘুম থেকে জাগি। তখন আত্মিক উন্নতির সেই শাশ^ত পথটি ধরে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। সেই পথ নবী রাসূলগণের, সকল যুগের আল্লাহর নেক বান্দাদের। সালাতুত তাহাজ্জুদ। দুই দুই রাকাত করে মোট আট রাকাত নামায। কুরআন মজীদের ভাষ্য থেকে জানা যায় স্বয়ং নবী রাসূলগণের আত্মিক উন্নতির নিয়ামক ছিল তাহাজ্জুদের নামায। আমাদের প্রিয়নবী ছিলেন জগতের সকল নবী রাসূলগণের শিরোমণি। তাকেও আল্লাহ তাআলা এই নেয়ামত গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বলছেন,

‘আপনি রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের নামায কায়েম করবেন। এটি আপনার উপর অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, আপনার প্রভু আপনাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’

(সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৭৮) আল্লাহর কাছে প্রশংসিত স্থানে উন্নীত হওয়ার সৌভাগ্য এই নামাযে নিহিত। তাহজ্জুদের এমনই অপার আধ্যাত্মিক শক্তি যে, এই মানায মানব চরিত্রে নিষ্ঠা, বুদ্ধি বিচক্ষণতা, চিন্তা ও সিদ্ধান্তে পরিপক্কতা, কথাবর্তায় সঠিকতার উন্মেষ ঘটায়। সূরা মুযযাম্মিল এর ভাষ্যটি দেখুন:

‘হে চাদর আবৃতকারী (ওহে প্রিয় নবী)! রাত জাগরণ করুন, কিছু অংশ ব্যতীত। রাতের অর্ধেক বা তার চেয়েও কম। কিংবা তার চেয়ে বেশি। আর কুরআন তেলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে। আমি আপনার প্রতি নাযিল করছি গুরুভার বাণী। অবশ্যই রাতের জাগরণ প্রবৃত্তি দলনে প্রবলতর এবং বাকস্ফুরণে সঠিক।’ (সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত-২-৬) নবুয়তের গুরুদায়িত্ব পালনে শক্তি সঞ্চার করে তাহাজ্জুদ। হাদিস শরীফে নবী করিম (সা) তাহাজ্জুদের সুফল বর্ণনা করে বলেছেন-

‘তোমরা রাত জেগে ইবাদত কর। কেননা, তা তোমাদের পূর্বেকার নেককার বান্দাদের রীতি ছিল। তার দ্বারা আল্লাহর সন্নিধ্য অর্জিত হয় এবং শরীর থেকে রোগশোক দূর হয়ে যায়।’ যুুগে যুগে আল্লাহ ওলী ও নেককার লোকদের আত্মিক উন্নতি ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের সম্বল তাহাজ্জুদ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করত। তারা রাতের শেষাংশে ক্ষমা প্রার্থনা করত।’

(সূরা যারিয়াত, আয়াত-১৭, ১৮) আল্লাহর যেসব বান্দা রাত জাগে, তাহাজ্জুদের নামায পড়ে তাদের প্রশংসা করেছেন আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত দরদভরা ভাষায়:

‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশংকায় এবং তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের পুরষ্কারস্বরূপ কী লুক্কায়িত রাখা হয়েছে কেউ জানে না।’ (সূরা সজিদা, আয়াত- ১৬-১৭) সময়ের গুরুত্ব চিন্তা করলে বুঝা যাবে তাহাজ্জুদে কেন এমন নেয়ামত নিহিত।

‘আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা প্রতিরাতেÑযখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে, দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানের দিকে নেমে আসেন আর বলতে থাকেন আমাকে আহŸান করার কেউ আছ কি আমি তার আহŸানে সাড়া দিতাম। আমার কাছে কিছু চাওয়ার কেউ কি আছ, আমি তাকে দান করতাম। আমার কাছে কে গোনাহ মার্জনা চাইবে আমি তার গোনাহ মাফ করে দিতাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)

তবে তাহাজ্জুদের নামাযে থাকতে হবে প্রাণের আহাজারি। উম্মতের দরদী প্রাণ দিশারি আল্লামা ইকবাল ইসলামী জাহানে আধ্যত্মিকতা ও চিন্তা মনীষার চারজন দিকপালের উপমা এনে বলেছেন- আত্তার হো রূমী হো, রাযী হো গাযযালী হো কুছ হাত নেহী আতা বে আহে সেহেরগাহী তুমি আত্তার হও বা রূমী, কিংবা গাযযালী বা রাজি শেষ রাতের আহাজারী ছাড়া তোমার জুটবে না কিছু। এই আলোচনা আমার নিজের মধ্যেও যাতে জাগ্রত চেতনার উজ্জীবন ঘটায় সেই প্রার্থনা মহান আল্লাহর দরবারে।

ধর্ম ও জীবন-এর আরও খবর