কক্সবাজারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন হবে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার

  বিশেষ প্রতিনিধি    29-07-2023    90
কক্সবাজারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন হবে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার

বাঁশের ছাপরায় পরিবার নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে থাকতাম। প্রতি বছর তুফান এলেই ভয়ে বুক কাঁপত। আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও সংসারের সবই ভেসে যেত। হালকা ঝড় হলেও ঘরের ক্ষতি হতো। প্রতি বছর ঘর মেরামত করতে অনেক টাকা লাগতো। এখন আর সেইদিন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দালান উপহার দিছেন।

আবেগাপ্লতু কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ভবনের ৪ তলার বাসিন্দা শাহনাজ। তিনি’ জানান, ঘর ছেড়ে এখন আর আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয় না। উল্টো উপকূলের যে কেউ ঘূর্ণিঝড়ের সময় এখানে আশ্রয় নিতে পারে। শুধু শাহনাজই নয়- আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্নভাবে গড়ে তোলা স্বপ্নের ভবনে উঠে খুশি অন্য উপকারভোগীরাও।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, জলবায়ু উদ্বাস্তু ও কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের ফলে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের জন্য এই আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এজন্য ৫ তলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে পুনর্বাসন করা হবে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারকে।

প্রতিটি পরিবারের জন্য রয়েছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, সুয়ারেজ লাইন, সোলার প্যানেল, প্রতিটি ভবনে রয়েছে গেস্ট হাউস, রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন সবকিছু। এর ফলে প্রকল্পের বাসিন্দারা নগরের বাসিন্দাদের মতো সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন। বিশ্বের কোনো আশ্রয়ণ প্রকল্পে এমন নাগরিক সুবিধা থাকার তথ্য নেই।

সরজমিন দেখা যায়, পশ্চিম ও দক্ষিণে বাঁকখালী নদী, উত্তরে মহেশখালী চ্যানেল আর পূর্ব পাশে পিএমখালী ইউনিয়ন। এর মাঝে রয়েছে খুরুশকুল ইউনিয়ন।

বলা যায়, খুরুশকুল নদীবেষ্টিত একটি ইউনিয়ন। আর এই ইউনিয়নে ১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক এই প্রকল্পটি। প্রতিটি ভবনে রয়েছে ৩২টি করে ফ্ল্যাট, প্রত্যেক ফ্ল্যাটে থাকবে একটি করে পরিবার। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন (মোট ব্যবহারযোগ্য) ৪০৬ দশমিক ৭ বর্গফুট, প্রতিটি তলায় রয়েছে কমন সার্ভিস সুবিধা। মোট ৪টি জোনের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। তবে ১৩৯টি ভবনের মধ্যে ইতোমধ্যে ২০টি ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি ভবনে ৬০০টি পরিবার প্রায় তিন বছর ধরে বসবাস করে

আসছে। কাজ চলমান থাকা বাকি ভবনগুলোরও কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে এসব ভবনে উপকারভোগীরা উঠতে পারবেন বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের প্রবেশ পথ রয়েছে ২টি, অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার। উপকারভোগীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ১টি প্রাথমিক ও ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রয়েছে ১৪টি খেলার মাঠ, ৩টি পুকুর, ১টি মসজি ও ১টি মন্দির। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল আফজাল হোসেন বলেন, এখানকার পানি লবণাক্ত। তাই দূর থেকে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ড্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। এতে এই প্রকল্পের উপকারভোগীরা ঢাকার বাসিন্দাদের মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে নির্মিত ২০টি ভবনে ৬০০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসিত পরিবারের জীবিকার সুবিধার্থে আধুনিক শুঁটকি মহাল, জীবন-মান উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা টাওয়ার স্থাপন ও তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া উপকারভোগীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও বাফার জোন স্থাপন করা হবে।

সরজমিন গত ২১ জুলাই আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, এক সারিতে গড়ে তোলা হয়েছে ভবনগুলো। ভবনের কাজ পুরোপুরি শেষ হলেও ভেতরে অবকাঠামো ও প্রকল্পের ভেতরের রাস্তার কাজ কিছুটা বাকি রয়েছে। সেসব কাজ চলছে পুরোদমে। ভবনগুলোর সামনে গোলাকার সবুজ বনায়ন করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে বিভিন্ন গাছের চারা। উত্তর পাশে রয়েছে বিশাল পাকা সড়ক। সে সড়ক ধরে কক্সবাজার শহরে, বাঁকখালীসহ অন্যান্য স্থানে সহজে যাতায়াত করছেন উপকারভোগীরা।

প্রকল্পে যাতায়াতের সুবিধার্থে বাঁকখালী নদীর উপর কক্সবাজার শহর থেকে খুরুশকুলের ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। সাদা রঙের ৫ তলা বিশিষ্ট ভবনগুলো দেখলে মনে হয়, আশ্রয়ণ নয়; যেন গ্রামের ভেতর একখণ্ড শহর।

দেখা যায়, প্রকল্পের দক্ষিণাংশে কাজ শেষ হওয়া ১৯টি ভবনে বসবাস করছেন উপকারভোগীরা। সেখানে রয়েছে স্কুল, খেলার মাঠ। পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তলা বিশিষ্ট নান্দনিক মসজিদ। বহুদূর থেকে দৃষ্টি কাড়ছে মসজিদের সুউচ্চ মিনার। এই অংশের ভবনগুলোর সুন্দর সুন্দর নাম রাখা হয়েছে। কথা হয় ভবনগুলোতে বসবাসরত একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে। এদের মধ্যে একজন আব্দুল আউয়াল।

নিলাম্বরী ভবনে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। ভবনটির নিচে ফাঁকা জায়গায় ভাতের দোকান রয়েছে তার। সেখানে বসেই কথা হয় আউয়ালের সঙ্গে। তিনি জানান, দোকান করে ৬ সদস্যের সংসার চালাচ্ছেন। আগে বিমানবন্দর এলাকার দক্ষিণ কুতুবদিয়ায় থাকতেন। ছনের ঘরে কোনো রকম জীবনযাপন করতেন।

বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ত। ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ে থাকতেন সব সময়। রাস্তা-ঘাট ভালো না হওয়ায় চলাফেরা করতে কষ্ট হতো। এই প্রকল্পে আসার পর এখন আর বছর বছর চালের ছন পরিবর্তন করতে হয় না, বৃষ্টি হলে পানি পড়ে না। ৬ সদস্য নিয়ে গত তিন বছর ধরে সুখেই বসবাস করে আসছেন। কেননা, তার ফ্ল্যাটে রয়েছে বারান্দা, কিচেন, ডায়নিং। দুই রুমে রয়েছে সংলগ্ন শৌচাগার।

কথা হয় ঝিনুক ভবনের বাসিন্দা নুর ইসলামের সঙ্গে। ভবনটির ৫ম তলায় তিনিও ৬ সদস্য নিয়ে বসবাস করে আসছেন। নুর ইসলামও দক্ষিণ কুতুবদিয়ায় থাকতেন। ’৯৮ সালের বন্যায় কুতুবদিয়া চর থেকে পানিতে ভাসতে ভাসতে দক্ষিণ কুতুবদিয়ায় এসে ওঠেন। এরপর থেকে সেখানেই কোনো রকম দিনাতিপাত করতেন। কখনো ভাবনেনি তার নিজের বাড়ি হবে, ঘর হবে।

অথচ বর্তমানে পাকা বহুতল ভবনে বসবাস করছেন। বাসিন্দাদের মধ্যে একটা ঐক্য আছে, একজনের বিপদে আরেকজন ছুটে আসে। এরকম সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ঘর করে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আজীবন দোয়া করে যাবেন, আবেগ আপ্লুত নুর ইসলাম এমনটিই বলছিলেন এই প্রতিবেদককে।

শুধু আব্দুল আউয়াল কিংবা নুর ইসলাম নয়; তাদের মতো এই প্রকল্পে বসবাসকারীরা একসময় উপকূলীয় এলাকার এমন একটা জায়গায় ছিলেন, সেখানে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়, বন্যার আতঙ্কে থাকতে হতো। এখন তারা শহরের সুবিধাসম্পন্ন ভবনে বসবাস করছেন।

প্রকল্পটি ঘুরে আরো দেখা যায়, প্রতিটি ভবনের নিচে রয়েছে গেস্ট হাউস। সেখানে উপকারভোগীদের অতিথি এলে তাদের থাকতে দেয়া হয়। রয়েছে ফাঁকা জায়গা। সেখানে বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান করা হয়। প্রতিটি ভবনে রয়েছে একটি দোকান করার জায়গা। সেসব জায়গায় কেউ ভাতের দোকান, কেউ চায়ের দোকান করছেন। রয়েছে জুয়েলার্সের দোকান, সেলুন, ফার্মেসি, ইলেকট্রনিক্সের দোকান। পাশে স্কুল মাঠে খেলা করছে শিশুরা।

১০টি ভবনের নিচ তলায় গড়ে তোলা হয়েছে এসকাস প্রকল্পের উদ্যোগে স্কুল। সেখানে শিক্ষা দেয়া হয় প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী দূরে স্কুল হওয়ার কারণে যেতে চায় না এবং অভাব-অনটনের কারণে যারা পড়তে পাড়ে না তাদের শিক্ষাদান করা হয়।

ঝিনুক ভবনের নিচ তলার স্কুলের শিক্ষিকা শারমিন আক্তার সুমি বলেন, প্রতিটি স্কুলে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের প্রতি মাসে ১২০ টাকা করে প্রণোদনাও দেয়া হয় প্রকল্প থেকে। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে। দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণও। এভাবে এখানকার শিশুদের শিক্ষাদানের ফলে শিশুশ্রম কমে আসছে।

সারাদেশ-এর আরও খবর