জব্দ ২২ হাজার পিস ইয়াবা কার পেটে

  বিশেষ প্রতিনিধি    14-09-2023    76
জব্দ ২২ হাজার পিস ইয়াবা কার পেটে

কক্সবাজার থেকে ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো হাঁকিয়ে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় ঢোকেন মাদক চক্রের সদস্য শুভ মোল্লা ও মাইন উদ্দিন সরকার সম্রাট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি, ইয়াবাসহ দু’জনই ধরা পড়েন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রিফাত হোসেনের নেতৃত্বে আভিযানিক দলটি গত ২২ আগস্ট গ্রেপ্তার করে তাদের। ৩০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হলেও মামলার বাদী রিফাত হোসেন এজাহারে দেখিয়েছেন ‘৮ হাজার’।

এদিকে আদালতে আসামিদের স্বীকারোক্তিতেই উঠে এসেছে, তারা ৩০ হাজার পিস ইয়াবার চালানসহ ধরা পড়েন। এ পটভূমিতে প্রশ্ন উঠেছে, ২২ হাজার পিস ইয়াবা গেল কোথায়? কার পেটে ঢুকল উদ্ধার হওয়া এত ইয়াবা!

এ ব্যাপারে মামলার বাদী ও আভিযানিক দলের প্রধান ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক (এডি) রিফাত হোসেন গতকাল বিকেলে সমকালকে বলেন, ‘ভাই, কালকে (আজ) অফিসে আসেন। অফিসে বসে কথা বলি।’ প্রশ্নের এক পর্যায়ে বলেন, ‘বিষয়টি মনে নেই। এজাহারও কাছে নেই। এজাহার দেখে বলতে হবে। পরে এজাহার দেখে ফোন করছি।’ এর পর তিনি নিজে ফোন করেননি। সন্ধ্যায় ফোন করা হলে বলেন, এজাহার হাতে পাননি তিনি।

মাদক উদ্ধার ও আসামি গ্রেপ্তারের ঘটনায় গত ২৩ আগস্ট রিফাত হোসেন বাদী হয়ে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলা করেন। এতে তিন স্থান থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা ও ১২ কেজি গাঁজা উদ্ধার এবং চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করা হয়।

মামলাটি তদন্ত করছেন ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের পরিদর্শক মাসুদুর রহমান। তিনি আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আসামি শুভ মোল্লা ও মাইন উদ্দিন সরকার সম্রাট ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম মো. মেহেদী হাসানের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানিতে শুভ বলেন, একই মামলার অপর আসামি জুম্মন তার বন্ধু। জুম্মন তাকে তরিকুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তরিকুলের নির্দেশমতো কাজ করেন তিনি। তরিকুলের ইয়াবা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দেওয়ায় কাজ তার। গত ২১ আগস্ট জুম্মন তাকে (শুভ) কক্সবাজারে নিয়ে যান। গোল্ডেন আবাসিক হোটেলে ওঠেন তারা। ওই দিন সন্ধ্যায় প্রাডো গাড়ির সিটের নিচে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হন। গাড়ি নষ্ট হওয়ায় রাতে কুমিল্লায় অবস্থান করেন। পরদিন দুপুরে ইয়াবার চালানটি নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান। এর পরই ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার থেকে শুভ, সম্রাট ও জুম্মন প্রাডো গাড়িতেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। তবে কুমিল্লায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জুম্মন অন্য গাড়িতে ঢাকায় চলে আসেন। পরদিন আসেন শুভ ও সম্রাট। সম্রাটও জবানবন্দিতে বলেছেন, ৩০ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে এসেছিলেন। এজাহারের একাংশে বলা হয়েছে, গত ২২ আগস্ট বিকেলে এডি রিফাত আভিযানিক দল নিয়ে বাড্ডার আফতাব নগরের নাসিরের গাড়ির গ্যারেজের সামনে গোপনে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো (ঢাকা মেট্রো ঘ–১১-১৬০৭) গাড়ি গতিরোধ করে তল্লাশি চালান। গাড়ির চালক মাইন উদ্দিন সরকার সম্রাট ও পাশের সিটে থাকা শুভ মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর চালকের আসনের নিচ থেকে ‘আট হাজার’ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। মামলায় সাক্ষী করা হয় গ্যারেজের মেকানিক হেলাল মিয়াসহ দু’জনকে।

সাক্ষী হেলাল মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। তিনি জানান, তাঁর গ্যারেজের সামনে থেকে গাড়িটি ধরা হয়নি। ডিএনসির কর্মকর্তারা দু’জনসহ প্রাডো গাড়িটি বাইরে থেকে ধরে তাদের গ্যারেজে আনেন। তাঁকে দিয়ে গাড়ির সিট খুলিয়ে ইয়াবা বের করেন তারা। তাঁর সামনে ইয়াবা গণনা করা হয়নি। হেলাল মিয়ার ভাষ্য, ইয়াবাসহ দু’জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনাস্থলও এজাহারে সঠিক দেওয়া হয়নি।

এজাহার ঘেঁটে দেখা গেছে, শুভ ও সম্রাটকে গ্রেপ্তারের পর একই আভিযানিক দল খিলগাঁওয়ের ‘সি’ ব্লকে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মাদক কারবারি মো. জুম্মন ও শেখ জিসানকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১২ হাজার পিস ইয়াবা। একই আভিযানিক দল ‘সি’ ব্লকের আরেকটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১২ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদকের চালান ধরলে ‘ডিএনসি মিডিয়া কভারেজ’ নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অভিযান ও উদ্ধার বিষয়ে তথ্য দেয়। গ্রুপটিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী যুক্ত আছেন। ডিএনসি গ্রুপটি পরিচালনা করে। ডিএনসির ঢাকার কর্মকর্তারা দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা কিংবা অন্য কোনো মাদক জব্দ করলেও সংবাদকর্মীদের জন্য গ্রুপে তথ্য দেন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের বড় চালানের তথ্যও দেওয়া হয়। তবে এজাহারে উল্লিখিত ২০ হাজার পিস ইয়াবা, ১২ কেজি গাঁজাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও সেই তথ্য গ্রুপে দেওয়া হয়নি। এডি রিফাত হোসেন তা চেপে যান।

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিনের দায়িত্বে থাকা ডিএনসির সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) ম. খালেদুল করিম বলেন, ঢাকার কর্মকর্তারা অভিযানে উদ্ধারবিষয়ক তথ্য নিজেরাই গ্রুপে দিয়ে থাকেন। তবে ওই চালানের তথ্য আভিযানিক দলের প্রধান রিফাত হোসেন কেন গ্রুপে দেননি তা আমি জানি না।

গত ১৯ জুন রিফাত হোসেনকে সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে মাদারীপুরে বদলি করা হয়। একই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া হয় শরীয়তপুর জেলা কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বও। ২১ জুনের মধ্যে রিফাতকে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। সূত্র জানিয়েছে, বদলির আদেশের পর রিফাত তদবির শুরু করেন। এর পর ২১ জুন আরেক আদেশে তাঁর বদলি বাতিল হয়। ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) মো. তানভীর মমতাজ বলেন, যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখব। কোনো কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত আছে কিনা, সেটিও দেখা হবে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের পরিদর্শক মাসুদুর রহমান বলেন, তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া তদন্তাধীন বিষয়ে বিস্তারিক কিছু বলা যাবে না। ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিদের রিমান্ডে আনার পর তাদের কাছে নতুন কী তথ্য পেয়েছেন, তা আমাকে জানানো হয়নি।সূত্র:সমকাল:

সারাদেশ-এর আরও খবর