বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার বিরোধিতায় বিশেষজ্ঞরা

  বিশেষ প্রতিনিধি    26-02-2024    44
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার বিরোধিতায় বিশেষজ্ঞরা

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক ব্যবস্থাপনার পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানাচ্ছেন, বিশেষ করে এই খাতের আর্থিক দুর্দশার আরো কার্যকর সমাধান হিসেবে অতিরিক্ত ও বিতর্কিত ব্যয়ের দিকে ইঙ্গিত করছেন। তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, বর্তমানে ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রয়েছে। ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকারের চুক্তিকেই এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এস এম শামসুল আলম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির বোর্ডের পারিশ্রমিক থেকে শুরু করে বড় আকারের বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি পর্যন্ত- ব্যাপক অযৌক্তিক খরচ রয়েছে। এছাড়া দাম বৃদ্ধির ওপর আর্থিক সংশোধনের প্রয়োজনীয়তায় জোর দেয়া প্রয়োজেন।’ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বিদ্যুৎ, উৎপাদন খরচ ও বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান মোকাবিলায় মার্চ থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও জাতীয় অর্থনীতির ওপর থেকে আর্থিক চাপ কমানোর লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। খুচরা ভোক্তাদের ওপর এ প্রভাব সর্বনিম্ন রাখা হবে বলে আশ্বাস দিয়ে হামিদ বলেন, ‘উৎপাদন খরচ মেটাতে খুচরা ও পাইকারি উভয় পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে হবে। তবে গ্যাসের দাম শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সমন্বয় করা যেতে পারে।’ দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথাগত শুনানি পাশ কাটিয়ে প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে পাইকারি বিদ্যুতের দামে পাঁচ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে তিন শতাংশ বৃদ্ধি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে সরকারের অভ্যন্তরের সূত্রগুলো। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১১ টাকা ৩৩ পয়সা এবং প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি হয়েছে ছয় টাকা সাত পয়সা। এ সময় প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে প্রায় চার টাকা ৬৩ পয়সা। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, কারণ বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অতি উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে সরকার। একই সময় নিজস্ব কেন্দ্র থেকে ১৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ সাত টাকা ৬৩ পয়সা, সেখানে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বা আইপিপির (বেসরকারি খাত) বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ পড়েছে ১৪ টাকা ৬২ পয়সা। এছাড়া রেন্টাল প্ল্যান্টে প্রতি ইউনিটে খরচ হয়েছে ১২ টাকা ৫৩ পয়সা, পাবলিক প্লান্টে ছয় টাকা ৮৫ পয়সা এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের খরচ আট টাকা ৭৭ পয়সা। বিপিডিবি সূত্র জানায়, গত দেড় দশকে ১১ বার পাইকারি পর্যায়ে এবং ১৩ বার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় হারের মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছে এবং এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় প্রায় ১২ টাকা এবং প্রতি ইউনিট বিক্রি হচ্ছে ছয় টাকা সাত পয়সায়। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) শুনানিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিষ্ঠানে অন্যায্য ব্যয়ের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এসব সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে তা অকার্যকর করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্যায্য ব্যয় কমাতে পদক্ষেপ নিতে সরকারের অনীহা দেখা গেছে। তিনি আরো বলেন, অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকারকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপারেটরদের বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এখন বাস্তবতা হচ্ছে, ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও শীতকালেও দেশে ব্যাপক লোডশেডিং হয়।’ তিনি বলেন, এত উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও সরকার বিদেশ থেকে নয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, এটা ‘হাস্যকর’। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সম্প্রতি এক সেমিনারে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে অতি উৎপাদিত বিদ্যুৎ সক্ষমতা হ্রাসের বিষয়টি অনুপস্থিত। সার্বিক ব্যয় কমাতে ব্যয়বহুল রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অবিলম্বে বন্ধের সুপারিশ করেন তিনি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এম তামিম বলেন, খরচ না কমিয়ে উৎপাদন খরচ বাড়ানোর দায় ভোক্তার ওপর চাপানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকারি ভর্তুকি কমানো যেতে পারে। কিন্তু এতে ডলার সঙ্কটেরও সমাধান হবে না, জ্বালানি আমদানি সমস্যারও সমাধান হবে না। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে লোডশেডিং ঠেকানো যাবে না।’ সূত্র : ইউএনবি

জাতীয়-এর আরও খবর