কারাগারে ছক, কেএনএফের সঙ্গে চুক্তি কক্সবাজারে

  বিশেষ প্রতিনিধি    28-10-2022    173
কারাগারে ছক, কেএনএফের সঙ্গে চুক্তি কক্সবাজারে

জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার উদ্দেশ্য ছিল সাংগঠনিক কাজে বাধা পেলে পাল্টা আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করা। এজন্য নিরাপদ জায়গা হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর আদলে অত্যাধুনিক কমান্ডো গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়, যারা দেশের অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করবে। নিরাপদে সশস্ত্র অপারেশনে অংশ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে ফিরে যাবে তারা।

বর্তমানে কমান্ডো টিমের প্রশিক্ষণে এয়ারগান, শটগান ও হালকা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হলেও দ্রুতই আসার কথা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রের একটি চালান।

আল-কায়েদার অনুসারী নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটি এখনো সাংগঠনিকভাবে কোনো অপারেশনাল কার্যক্রমে না গেলেও সক্ষমতা অর্জনের পর উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠায় অপারেশন পরিচালনার কথা রয়েছে। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ঊর্ধŸতন সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এদিকে বুধবার রাজধানীর ডেমরা থেকে শারক্বীয়ার পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি।

তারা হলেন- নাটোরের আবদুল্লাহ, কুমিল্লার চান্দিনার তাজুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের জিয়াউদ্দিন ও মাহামুদুল হাসান এবং মাদারীপুরের হাবিবুল্লাহ। তাদের থেকে তিনটি মোবাইল ফোন ও ফতোয়া-সংক্রান্ত ১২ পাতা কাগজ জব্দ করা হয়েছে। সিটিটিসি সূত্র জানান, হিজরতকারীদের ক্যাম্পে নিয়ে তিন ভাগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রথম ধাপে পাহাড়ের ক্যাম্পে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধকৌশল ডামি অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। শেষ ধাপে প্যাট্রলিং শেখানো হতো। সংগঠনটির নেতৃত্ব দেওয়া শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার রংপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হয়ে নিষিদ্ধ জামাআতুল মুসলিমিনের (জেএম) মাধ্যমে জঙ্গিবাদে নাম লেখান। শুরু থেকেই তার টার্গেট ছিল ভিন্ন ধরনের একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করা।

কিন্তু ২০১১ সালে জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এরপর ২০১৪ সালে পৃথক আরেকটি মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান মাহফুজ।

মূলত ওই সময়ই তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি হুজির সদস্য মাওলানা আবু সাঈদ ও একিউআইএসের প্রধান সমন্বয়কারী মুফতি মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সির সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হন। কারাগারে থাকতেই রক্সি আশ্বস্ত করেন তার সংগঠনের শুরা সদস্যদের এ সংগঠনে যুক্ত করে দিতে পারবেন। সে মোতাবেক ২০১৭ সালে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর নতুন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে হেডকোয়ার্টার বান্দরবানে করার সিদ্ধান্ত নেন মাহফুজ। পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনগুলো নিজেদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে অনুধাবন করে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করেন। কেএনএফের নেতৃত্বে ছিলেন নাথান বম। এরই মধ্যে নাথান বম ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। এরপর খোঁজ নিয়ে মাহফুজ জানতে পারেন কেএনএফের নেতৃত্বে থাকা এই নাথান বম ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও তার একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে মিলিত হন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাহফুজ, রক্সি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা মহসীন ওরফে রিয়েল এবং বিকাশ ও তমাল। কেএনএফের পক্ষ থেকে বৈঠকে ছিলেন নাথান বম ও তার দুই সহযোগী। বৈঠকে প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচ ও অস্ত্রের জোগান দেওয়ার আশ্বাস দেন মাহফুজ।

গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে সাত তরুণ নিখোঁজ হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতার করা হয় সংগঠনটির বেশ কয়েকজন সদস্যকে। এরই ধারাবাহিকতায় হিজরতের নামে ঘরছাড়া পাঁচ তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আনসার হাউস (শেল্টার হোম) পরিচালনা করতেন গ্রেফতার আবদুল্লাহ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেত তাদের এই আনসার হাউসে জায়গা দেওয়া হতো। পরে সেই আনসার হাউস থেকে আবদুল্লাহ এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে পাঠাতেন। এ ছাড়া গ্রেফতার তাজুল ও হাবিবুল্লাহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য আনসার হাউসে আসতেন তাদের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসতেন।

তিনি বলেন, ‘কুমিল্লার সাত তরুণ নিখোঁজ হওয়ার পর অভিযানে নেমে আবরার নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করি। আবরারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী নামে এক জঙ্গি আবরারকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালীকেও গ্রেফতার করা হয়। এই শাকের বিন ওয়ালী হচ্ছেন এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান। শাকের বিন ওয়ালী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস করেছেন। তিনি জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি আরেক হুজুরের নির্দেশে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতেন। চিকিৎসা দিতে এই শাকের বিন ওয়ালী প্রতি মাসে একবার বান্দরবানে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। এ ছাড়া জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের সদস্যরা আহত হলেও সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিতেন ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী।

সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, সোমবার ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা এবং এর কার্যক্রম সম্পর্কে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। নতুন সংগঠন তৈরির বিষয়ে ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, নতুন সংগঠনটির প্রথম আমির মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। সিটিটিসি ২০২১ সালে রক্সিকে গ্রেফতারের পর সব ধরনের দায়িত্ব পালন করছেন শামিন মাহফুজ।

এ সংগঠনের কতজন সদস্য হিজরতের নামে নিখোঁজ রয়েছেন- জানতে চাইলে সিটিটিসির প্রধান বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ৭০ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। হয়তো সবাই প্রশিক্ষণে যাননি। আমরা যতটুকু জানি তিন ধাপে প্রশিক্ষণ শিবিরে লোক পাঠানো হয়েছে। তবে সবাই সেখানে যাননি। অনেকে কোনো শেল্টার হোমে থাকতে পারেন। অথবা আগের হিজরতে ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদ স্থানে আছেন। ’

নতুন জঙ্গি সংগঠনের নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, হয়তো তাদের এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে। তবে সংগঠনের প্রধানকে গ্রেফতার করা গেলে বিস্তারিত জানা যাবে। মাহফুজের স্ত্রীও সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত বলে জানান সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান। সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

সারাদেশ-এর আরও খবর