রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সেবা দিচ্ছে হাইসাওয়া

  বিশেষ প্রতিনিধি    10-11-2022    132
রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সেবা দিচ্ছে হাইসাওয়া

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সেবা হুমকির মুখে পড়ে। প্রান্তিক এলাকায় সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাসকারী মানুষের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য সেবা ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে এমন আরো প্রকল্প প্রয়োজন।

বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) কক্সবাজারের সিগাল হোটেলে, ডেনমার্ক এবং সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় কক্সবাজারে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ওয়াস সেবা প্রদানের সমাপনী কর্মশালার আয়োজন করেছে হাইসাওয়া।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ খাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য পানি ও স্যানিটেশন সেবা প্রদানের জন্য রোহিঙ্গাদের আগমনের পর এই প্রকল্প খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। হাইসাওয়ার প্রকল্পটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ৪ হাজারের বেশি পানি পানির উৎস ও টয়লেট নির্মাণ করেছে, আমি এটা দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। স্থানীয় সরকার বিভাগ এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে, বিশেষ করে পানি ও স্যানিটেশনে অনেক কাজ করছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায়, হাইসাওয়া এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করছে।’

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মায়ানমার হতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেও প্রতি বাংলাদেশ সরকার এবং কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ অত্যন্ত সদয় আচরণ করেছে এবং আশ্রয় দিয়েছে। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার জনগণ তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু এই দুই উপজেলাতেই অনেক মৌলিক সেবা বিশেষ করে পানি ও স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে। শক্তিশালী সেবা নিশ্চিত করার জন্য, স্থানীয় সরকার বিভাগ হাইসাওয়া প্রতিষ্ঠা করে। হাইসাওয়া এই দুই উপজেলায় পানি এবং স্যানিটেশন সেবা প্রদান করায় এসেছে আমি আনন্দিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই প্রকল্পে হাইসাওয়াকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করায় জন্য আমি ডেনমার্ক এবং সুইজারল্যান্ড উভয় দূতাবাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।’

হাইসাওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে ডেনমার্ক দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন আন্দ্রেস বি. কার্লসেন, বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব কো-অপারেশন কোরিন হ্যাঞ্জহগ পিগনানি, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মোঃ জসিম উদ্দিন, মোহাম্মদ ফজলে আজিম, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: মামুনুর রশীদ ও ভারপ্রাপ্ত ডিডিএলজি জাহিদ ইকবাল।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, হাইসাওয়া বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক সংস্থা। সংস্থাটি ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ নিয়ে কাজ করে। ২০০৮ সাল থেকে, বেসরকারী অলাভজনক সংস্থা হাইসাওয়া (হাইজিন, স্যানিটেশন এবং ওয়াটার সাপ্লাই) বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশি গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে ওয়াশ (পানি, স্যানিটেশন, হাইজিন) পরিষেবা সরবরাহ করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে, হাইসাওয়া মোট ২৭টি জেলায় কাজ করেছে এবং ১১০০ টিরও বেশি ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করেছে।

কক্সবাজারে এই ৪ বছরের প্রকল্পের মাধ্যমে (২০১৯-২০২২, ডেনমার্ক এবং সুইজারল্যান্ডের অর্থায়নে), হাইসাওয়া ১৮০৬ টি নলকূপ সহ ৪৫০০ টিরও বেশি নিরাপদ পানির উৎস স্থাপন করেছে। ১০০০টি ব্যাকটেরিয়া নিরোধক পানির ফিল্টার, ৮টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্ল্যান্ট, টেকনাফের সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি পাইপ ওয়াটার সরবরাহ ব্যবস্থা এবং টেকনাফের একটি রিভার্স অসমোসিস স্যালাইন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। সেই পানির উৎসগুলো ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি প্রান্তিক গ্রামীণ জনগণকে পরিষেবা দিয়ে আসছে। একইসাথে কক্সবাজারে ১৯৮৯টি উন্নত গৃহস্থালী ল্যাট্রিন, ১৫৬টি পাবলিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ল্যাট্রিন স্থাপন করেছে। এছাড়া হাইসাওয়া টেকনাফ ও উখিয়ায় ১০০টি হাত ধোয়ার স্টেশন তৈরি করেছে এবং ৬০০টি হাত ধোয়ার ডিভাইস স্থাপন করেছে। এই প্রকল্পের সময়কালে হাইসাওয়া কতৃক আয়োজিত স্বাস্থ্যবিধি প্রচার সেশন গুলোতে ৩ লাখের বেশি লোক অংশগ্রহণ করেছিল। হাইসাওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রায় ৩.৫ লক্ষ মানুষকে ওয়াশ পরিষেবা দিয়েছে।

হাইসাওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল ওসমান বলেন, ‘আমরা যখন ২০১৮ সালে এই প্রকল্পটি শুরু করেছিলাম, তখন প্রধান সমস্যাটি ছিল যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সম্প্রদায়কে ওয়াশ পরিষেবা প্রদান করা। আমাদের শুরুটা খুব ভালো ছিল, প্রকল্পের প্রথম বছর খুব ভালোভাবে কাটেছে, তারপরে এল কোভিড মহামারী। ঝুঁকি এবং বিধিনিষেধ থাকা সত্তে¡ও, কক্সবাজারের ইউনিয়ন পরিষদ এবং আমাদের দল প্রকল্পটি চালু রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং হাইসাওয়া টিমকে করোনা মহামারীর সময় তাদের দুর্দান্ত কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

হাইসাওয়া মূলত এমন এলাকায় কাজ করে যেখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট, দুর্বল স্যানিটেশন এবং প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি রয়েছে এমন এলাকায়। এ পর্যন্ত, সংস্থাটি সারা দেশে ৮৪ হাজারেরও বেশি পানির উৎস স্থাপন করেছে, প্রকল্প এলাকায় ১৭ লাখেরও বেশি স্যানিটারি ল্যাট্রিন নির্মাণ ও সংস্কার করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে, হাইসাওয়া গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি সেবা প্রদান করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে হাত ধোয়া, ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, ল্যাট্রিন হাইজিন, ফুড হাইজিন, নিরাপদ পানির পরিকল্পনা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

এছাড়াও হাইসাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন নিয়েও কাজ করে। সংস্থাটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জলবায়ু সহনশীল পানির উৎস এবং ল্যাট্রিন স্থাপন করে। হাইসাওয়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় উচ্চ প্ল্যাটফর্মে জলের উৎস এবং ল্যাট্রিন স্থাপন করে। জলবায়ু-সহনশীল নলকূপ এবং ল্যাট্রিন নির্মাণের পাশাপাশি, হাইসাওয়া প্রকল্প এলাকার মানুষকে উন্নত ধোঁয়া-মুক্ত চুলার ব্যবহার করার পাশাপাশি বৃক্ষরোপন এবং পরিবেশ রক্ষা করতে সৌর প্যানেল ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও, সংস্থাটি লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এবং প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও কাজ করে।

হাইসাওয়া জলের উৎস এবং ল্যাট্রিন স্থাপনে ইউনিয়ন পরিষদকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। সংস্থাটি পানির উৎস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি নলকূপের জন্য দু’জন ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রয়োজনীয় মেরামত যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ও পাবলিক ল্যাট্রিন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কমিটিও গঠন করা হয়। পৌরসভার মেয়র, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার প্রতনিধিবৃন্দও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সারাদেশ-এর আরও খবর