কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি অবসাদ দূর করতে ছুটি পেলেই মানুষ ছুটে যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সুনীল সাগরে নিজের সব ক্লান্তি দূর করে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে।
সমুদ্রের বুকে গর্জে ওঠা ঢেউগুলো যখন তীরে আছড়ে পড়ে, তখন যেন সেখানকার মানুষের দুঃখগুলো নিমিষেই শুষে নিয়ে চলে যায়। তবে সবাই অখণ্ড অবসর কাটাতে সাগরে ছুটলেও কিছু মানুষ ছোটে বাঁচার তাগিদে। এ বিশাল সমুদ্র সৈকতই তাদের জীবিকা। বিচিত্র সব পেশার সমাহার ঘটেছে এ বালুকাবেলায়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন সব সৌখিনতা সমুদ্রপাড়ের মানুষের পেশা হয়ে উঠেছে। আর তাদের পেশার কারণেও অনেকটা ভিন্ন আকর্ষণ ও বৈচিত্রতা পেয়েছে এ সমুদ্র সৈকত।
সৈকতে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য কেউ ঘোড়া নিয়ে হাজির, কেউ পর্যটকদের সমুদ্রে গোসল নিরাপদ করতে টিউব সরবরাহ করছেন লাইফ জ্যাকেটের বিকল্প হিসেবে। আবার কেউ সমুদ্রের নোনাজলের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানোর সেই রোমাঞ্চকর স্বাদ দিতে দিচ্ছেন জেড স্কি চালানোর সুযোগ। আর এ সবকিছুই একদিকে পর্যটকদের সৌখিনতা অন্যদিকে পর্যটন শহরের মানুষের আয়ের উৎস। তারা এ পেশার মাধ্যমে জীবন-জীবিকার জোগান মেটান। তাই এ সমুদ্র সৈকতই তাদের একমাত্র কর্মস্থল। এখানেই দিন কাটে, রাত কাটে; ভোর হয় অনেকের। রোজ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি জীবনের ঘানি টেনে যান তারা।
এমনই এক পেশা- ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী। হাতে দামি স্মার্টফোন থাকলেও অত্যাধুনিক লেন্সযুক্ত ডিএসএলআর ক্যামেরায় চকচকে ছবি তুলতে কার না ভালো লাগে? আর সেই ছবি যদি হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে, তাহলে তো কথাই নেই। কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে তাই নিবন্ধিত অনেক আলোকচিত্রী কাজ করছেন গেল বেশ কয়েক বছর ধরেই। সৈকতে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন এসব তরুণ ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী। তবে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দর দাম নিয়ে পর্যটকদের হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায় প্রায়ই।
পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ায় বর্তমানে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যেন আলোকচিত্রীর ছড়াছড়ি। পর্যটকদের দেখলেই ছবি তুলে দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন একাধিক আলোকচিত্রী। আকর্ষণ বাড়াতে বিভিন্ন প্যাকেজও অফার করেন। সৈকতে বেড়াতে আসা এমন কিছু পর্যটকও থাকেন যাদের কাছে ভালো স্মার্টফোন কিংবা ক্যামেরা নেই। মূলত তারা এসব আলোকচিত্রীর মাধ্যমে নিজেদের ফ্রেমবন্দী করেন। সমুদ্রসৈকতে অবস্থানরত আলোকচিত্রীরা পর্যটকদের কাছ থেকে ছবি প্রতি পাঁচ থেকে ১০ টাকা নেন। আর যদি কেউ ছবির প্রিন্ট আউট চান, সেক্ষেত্রে প্রতি ছবির জন্য ১৫ থেকে ২০ টাকা নেওয়া হয়। তবে তারা সাধারণত ছবি তুলে পর্যটকের মেমরি কার্ড বা পেনড্রাইভেই দিয়ে দেন।
দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্র সৈকতে আলোকচিত্রী হিসেবে পর্যটকদের ছবি তুলছেন মশিউর রহমান। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সৈকতে আসা অনেক সৌখিন পর্যটক শখ করে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে নেন। সৈকতে প্রায় ৮০০ জন আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন। আগে ছবি তুলে আমরা দোকানে নিয়ে প্রিন্ট করে ডেলিভারি দিতাম। এখন পর্যটকদের হাতে হাতে তাদের স্মার্টফোনেই ছবি দিয়ে দিই। এ কাজ করে আমারা প্রতি মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হয়। এখন প্রায় সবার হাতেই দামি মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা থাকে। যে কারণে অনেক পর্যটক আমাদের কাছে ছবি তুলতে চান না।
এদিকে সৈকতে বালুর মধ্যে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে পর্যটকদের বসার জন্য বিশেষ ‘চেয়ার ছাতা’, যা ‘কিটকট’ হিসেবে পরিচিত। কিটকটের পাশে দাঁড়িয়ে দেখাশোনা করছেন কিটকটের মালিক মো. কালাম। সৈকতে তার রয়েছে আটটি কিটকট। তার আটটি কিটকট পরিচালনায় কর্মচারী আছেন দুইজন।
কালাম বাংলানিউজকে বলেন, ১০ বছর ধরে সৈকতে কিটকটের ব্যবসা করছি। পর্যটক যখন সৈকতে ভরপুর থাকেন, তখন কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করে দৈনিক দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে। মাত্র ৩০ টাকা ঘণ্টা ভাড়া নিয়ে এখানে শুয়ে-বসে যে কেউ সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
সৈকতের সবচেয়ে পুরনো পেশাগুলোর একটি পর্যটকদের ঘোড়ায় চড়ানো। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলী পয়েন্ট ছাড়াও ইনানী, হিমছড়ি, পাটুয়ারটেক ও দরিয়ানগরে শতাধিক ঘোড়ার বিচরণ রয়েছে। এসব ঘোড়ায় চড়ে পর্যটকরা আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। ঘোড়াকে কেন্দ্র করে অন্তত দুই শতাধিক মানুষ এ ঘোড়া ব্যবসায় সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সুগন্ধা বিচে ঘোড়ার পিঠে চড়ে একবার চক্কর দিলে পরিশোধ করতে হয় ২৫০ টাকা। আর এক ঘণ্টায় নেওয়া হয় এক হাজার ৫০০ টাকা।
সৈকতের ঘোড়া মালিক নুরুল আলম বলেন, ইদানিং ঘোড়ার ব্যবসায়ও মন্দা যাচ্ছে। দৈনিক যা আয় হয় তার মধ্যে প্রতিদিন এক হাজার টাকার ওপরে শুধু ঘোড়ার খাবারের পেছনেই চলে যায়। বাকি যে সামান্য টাকা থাকে তা থেকে স্থানীয় সমিতি ও আমার ছেলেদের পড়াশোনার খরচ এবং সংসার চালাতেই চলে যায়। তাও আবার প্রতিদিন একরকম আয় হয় না।
কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের কেন্দ্র করে বিচ বাইক এবং ওয়াটার বাইক (জেট স্কি)। সৈকতের বালুচরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ১৫০ বিচ বাইক। সৈকতের আধা কিলোমিটার বালুচর ঘুরে এলে পর্যটককে গুনতে হয় ২০০ টাকা। একটু দূরে দুই কিলোমিটার ঘুরে এলে পরিশোধ করতে হয় ৫০০ টাকা। বাইকে চালকের সঙ্গে বসতে পারেন সর্বোচ্চ তিনজন পর্যটক। পর্যটকের ভিড় থাকলে প্রতিটি বাইকের দৈনিক ২০ থেকে ৩০টি রাউন্ড হয় বলে জানান সুগন্ধা বিচের বাইক চালকেরা।
বিচ বাইক চালিয়ে দৈনিক প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাদের। কমিশনের ভিত্তিতে বাইক চালান তারা। এক হাজার টাকা আয় হলে চালকেরা কমিশন পান ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ২৫০-৩০০ টাকা। দৈনিক একজন চালকের সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকাও আয় হয়। অন্যদিকে বিচ বাইকের মতো সমান জনপ্রিয় ওয়াটার বাইক (জেট স্কি)। সৈকতে হাতেগোনা কয়েকটি ওয়াটার বাইক রয়েছে। এসব নৌযানে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির নির্দিষ্ট দূরত্বে ঘুরে আসতে পরিশোধ করতে হয় ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কারও কারও কাছে আরও বেশিও নেওয়া হয়।
কক্সবাজারে গেলে যে কেউই সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নেন। এজন্য পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা হয়ে উঠেছে সৈকত সংলগ্ন মাছ ফ্রাইয়ের দোকানগুলো। সৈকতের পাড়েই সামুদ্রিক মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন তারা। গ্রাহকের মনের মতো করে মাছ-কাঁকড়া ভেজে বিক্রি করেন তারা। এর মাধ্যমেই চলে জীবন-জীবিকা।
এখানে ফিস বারবিকিউ এর মধ্যে জনপ্রিয় টুনা, কোরাল, ইলিশ, চিংড়ি, ছুরি, লইট্টা, চ্যাপা ইত্যাদি। পাশাপাশি জনপ্রিয় কাঁকড়া ফ্রাই। বড় থেকে ছোট আকৃতিক হরেক কাঁকড়া রাখা হয়েছে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী। আকার অনুযায়ী কাঁকড়ার দামের ভিন্নতা রয়েছে প্রতিটি দোকানে। মাছ এর দাম রাখা হয় ওজনের ওপর ভিত্তি করে। এরপর গ্রাহকের সামনেই পছন্দ করা মাছ বা কাঁকড়া ফ্রাই বা বারবিকিউ করে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর এসব দোকানগুলোতে ভিড় জমে ওঠে।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে মাছ ফ্রাইয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকানের মালিক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ফিশ ফ্রাই বা কাঁকড়া ফ্রাই করে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন। এক দশক আগেও এসব খাবারের চাহিদা ছিল না। এখন পর্যটকদের মধ্যে এ ধরনের খাবারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে ব্যবসাও বেড়েছে।
কক্সবাজারে গেলেই পর্যটকরা ঢুঁ মারেন সৈকতের ঝিনুক-শামুকের দোকানগুলোতে। কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকূলীয় পয়েন্টে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে ৫০ থেকে ৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক। এগুলো দিয়ে তৈরি হয় মালা, দুল, পুতুল, চুড়ি, ব্রেসলেট, ক্লিপ, ওয়ালমেট, ল্যাম্পশেড ও ঝাড়বাতি। আবার বড় সাইজের শামুকের ওপর অঙ্কন করার ব্যবস্থাও আছে।
সুগন্ধ্যা পয়েন্টের ঝিনুক ব্যবসায়ী রেজাউল বলেন, কক্সবাজার সৈকতে এ পণ্যের ব্যবসায় আছেন প্রায় ৬০০ মানুষ। তবে প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এ ব্যবসা জমজমাট চললেও অন্য সময়ে পর্যটক কম থাকায় সংকটে পড়তে হয়। এক বছর আগেও সৈকতে শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন আয় হতো অন্তত পাঁচ হাজার টাকা। এখন প্রতিদিন আয় হয় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা।
এছাড়া সমুদ্র সৈকতে নানা পণ্য নিয়ে ব্যবসা করেন অসংখ্য হকার। এসব হকারদের ৯০ শতাংশই শিশু। এসব হকার সৈকতে কড়ি, শামুক বা ঝিনুকের তৈরি মালা, কানের দুল, ব্রেসলেট বিক্রি করে। আবার অনেকের রয়েছে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। সেখানে তারা সিদ্ধ ডিম, ঝালমুড়ি, ডাব, চা, কফি, খাবার পানি বিক্রি করে। কিছু শিশু পর্যটকদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ম্যাসাজ করেও আয় করে।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টে শামুক-ঝিনুকের তৈরি মালা বিক্রি করেন শিশু নাহিদুল ইসলাম। সে বলে, খুব ভোরে এসে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা শামুক, ঝিনুক ও কড়ি কুড়িয়ে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মালা ও দুল তৈরি করে সৈকতে বিক্রি করতে নিয়ে আসি। এসব পণ্য বিক্রির পাশাপাশি পর্যটকদের মাথা, হাত-পা ম্যাসাজ করি। আধা ঘণ্টা ম্যাসাজ করলে ২০ টাকা পাই। ম্যাসাজ করে দৈনিক দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা পাই।
সৈকতেই জীবন-জীবিকা
কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি অবসাদ দূর করতে ছুটি পেলেই মানুষ ছুটে যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সুনীল সাগরে নিজের সব ক্লান্তি দূর করে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে।
সমুদ্রের বুকে গর্জে ওঠা ঢেউগুলো যখন তীরে আছড়ে পড়ে, তখন যেন সেখানকার মানুষের দুঃখগুলো নিমিষেই শুষে নিয়ে চলে যায়। তবে সবাই অখণ্ড অবসর কাটাতে সাগরে ছুটলেও কিছু মানুষ ছোটে বাঁচার তাগিদে। এ বিশাল সমুদ্র সৈকতই তাদের জীবিকা। বিচিত্র সব পেশার সমাহার ঘটেছে এ বালুকাবেলায়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন সব সৌখিনতা সমুদ্রপাড়ের মানুষের পেশা হয়ে উঠেছে। আর তাদের পেশার কারণেও অনেকটা ভিন্ন আকর্ষণ ও বৈচিত্রতা পেয়েছে এ সমুদ্র সৈকত।
সৈকতে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য কেউ ঘোড়া নিয়ে হাজির, কেউ পর্যটকদের সমুদ্রে গোসল নিরাপদ করতে টিউব সরবরাহ করছেন লাইফ জ্যাকেটের বিকল্প হিসেবে। আবার কেউ সমুদ্রের নোনাজলের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানোর সেই রোমাঞ্চকর স্বাদ দিতে দিচ্ছেন জেড স্কি চালানোর সুযোগ। আর এ সবকিছুই একদিকে পর্যটকদের সৌখিনতা অন্যদিকে পর্যটন শহরের মানুষের আয়ের উৎস। তারা এ পেশার মাধ্যমে জীবন-জীবিকার জোগান মেটান। তাই এ সমুদ্র সৈকতই তাদের একমাত্র কর্মস্থল। এখানেই দিন কাটে, রাত কাটে; ভোর হয় অনেকের। রোজ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি জীবনের ঘানি টেনে যান তারা।
এমনই এক পেশা- ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী। হাতে দামি স্মার্টফোন থাকলেও অত্যাধুনিক লেন্সযুক্ত ডিএসএলআর ক্যামেরায় চকচকে ছবি তুলতে কার না ভালো লাগে? আর সেই ছবি যদি হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে, তাহলে তো কথাই নেই। কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে তাই নিবন্ধিত অনেক আলোকচিত্রী কাজ করছেন গেল বেশ কয়েক বছর ধরেই। সৈকতে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন এসব তরুণ ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী। তবে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দর দাম নিয়ে পর্যটকদের হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায় প্রায়ই।
পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ায় বর্তমানে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যেন আলোকচিত্রীর ছড়াছড়ি। পর্যটকদের দেখলেই ছবি তুলে দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন একাধিক আলোকচিত্রী। আকর্ষণ বাড়াতে বিভিন্ন প্যাকেজও অফার করেন। সৈকতে বেড়াতে আসা এমন কিছু পর্যটকও থাকেন যাদের কাছে ভালো স্মার্টফোন কিংবা ক্যামেরা নেই। মূলত তারা এসব আলোকচিত্রীর মাধ্যমে নিজেদের ফ্রেমবন্দী করেন। সমুদ্রসৈকতে অবস্থানরত আলোকচিত্রীরা পর্যটকদের কাছ থেকে ছবি প্রতি পাঁচ থেকে ১০ টাকা নেন। আর যদি কেউ ছবির প্রিন্ট আউট চান, সেক্ষেত্রে প্রতি ছবির জন্য ১৫ থেকে ২০ টাকা নেওয়া হয়। তবে তারা সাধারণত ছবি তুলে পর্যটকের মেমরি কার্ড বা পেনড্রাইভেই দিয়ে দেন।
দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্র সৈকতে আলোকচিত্রী হিসেবে পর্যটকদের ছবি তুলছেন মশিউর রহমান। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সৈকতে আসা অনেক সৌখিন পর্যটক শখ করে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে নেন। সৈকতে প্রায় ৮০০ জন আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন। আগে ছবি তুলে আমরা দোকানে নিয়ে প্রিন্ট করে ডেলিভারি দিতাম। এখন পর্যটকদের হাতে হাতে তাদের স্মার্টফোনেই ছবি দিয়ে দিই। এ কাজ করে আমারা প্রতি মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হয়। এখন প্রায় সবার হাতেই দামি মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা থাকে। যে কারণে অনেক পর্যটক আমাদের কাছে ছবি তুলতে চান না।
এদিকে সৈকতে বালুর মধ্যে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে পর্যটকদের বসার জন্য বিশেষ ‘চেয়ার ছাতা’, যা ‘কিটকট’ হিসেবে পরিচিত। কিটকটের পাশে দাঁড়িয়ে দেখাশোনা করছেন কিটকটের মালিক মো. কালাম। সৈকতে তার রয়েছে আটটি কিটকট। তার আটটি কিটকট পরিচালনায় কর্মচারী আছেন দুইজন।
কালাম বাংলানিউজকে বলেন, ১০ বছর ধরে সৈকতে কিটকটের ব্যবসা করছি। পর্যটক যখন সৈকতে ভরপুর থাকেন, তখন কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করে দৈনিক দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে। মাত্র ৩০ টাকা ঘণ্টা ভাড়া নিয়ে এখানে শুয়ে-বসে যে কেউ সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
সৈকতের সবচেয়ে পুরনো পেশাগুলোর একটি পর্যটকদের ঘোড়ায় চড়ানো। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলী পয়েন্ট ছাড়াও ইনানী, হিমছড়ি, পাটুয়ারটেক ও দরিয়ানগরে শতাধিক ঘোড়ার বিচরণ রয়েছে। এসব ঘোড়ায় চড়ে পর্যটকরা আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। ঘোড়াকে কেন্দ্র করে অন্তত দুই শতাধিক মানুষ এ ঘোড়া ব্যবসায় সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সুগন্ধা বিচে ঘোড়ার পিঠে চড়ে একবার চক্কর দিলে পরিশোধ করতে হয় ২৫০ টাকা। আর এক ঘণ্টায় নেওয়া হয় এক হাজার ৫০০ টাকা।
সৈকতের ঘোড়া মালিক নুরুল আলম বলেন, ইদানিং ঘোড়ার ব্যবসায়ও মন্দা যাচ্ছে। দৈনিক যা আয় হয় তার মধ্যে প্রতিদিন এক হাজার টাকার ওপরে শুধু ঘোড়ার খাবারের পেছনেই চলে যায়। বাকি যে সামান্য টাকা থাকে তা থেকে স্থানীয় সমিতি ও আমার ছেলেদের পড়াশোনার খরচ এবং সংসার চালাতেই চলে যায়। তাও আবার প্রতিদিন একরকম আয় হয় না।
কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের কেন্দ্র করে বিচ বাইক এবং ওয়াটার বাইক (জেট স্কি)। সৈকতের বালুচরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ১৫০ বিচ বাইক। সৈকতের আধা কিলোমিটার বালুচর ঘুরে এলে পর্যটককে গুনতে হয় ২০০ টাকা। একটু দূরে দুই কিলোমিটার ঘুরে এলে পরিশোধ করতে হয় ৫০০ টাকা। বাইকে চালকের সঙ্গে বসতে পারেন সর্বোচ্চ তিনজন পর্যটক। পর্যটকের ভিড় থাকলে প্রতিটি বাইকের দৈনিক ২০ থেকে ৩০টি রাউন্ড হয় বলে জানান সুগন্ধা বিচের বাইক চালকেরা।
বিচ বাইক চালিয়ে দৈনিক প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাদের। কমিশনের ভিত্তিতে বাইক চালান তারা। এক হাজার টাকা আয় হলে চালকেরা কমিশন পান ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ২৫০-৩০০ টাকা। দৈনিক একজন চালকের সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকাও আয় হয়। অন্যদিকে বিচ বাইকের মতো সমান জনপ্রিয় ওয়াটার বাইক (জেট স্কি)। সৈকতে হাতেগোনা কয়েকটি ওয়াটার বাইক রয়েছে। এসব নৌযানে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির নির্দিষ্ট দূরত্বে ঘুরে আসতে পরিশোধ করতে হয় ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কারও কারও কাছে আরও বেশিও নেওয়া হয়।
কক্সবাজারে গেলে যে কেউই সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নেন। এজন্য পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা হয়ে উঠেছে সৈকত সংলগ্ন মাছ ফ্রাইয়ের দোকানগুলো। সৈকতের পাড়েই সামুদ্রিক মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন তারা। গ্রাহকের মনের মতো করে মাছ-কাঁকড়া ভেজে বিক্রি করেন তারা। এর মাধ্যমেই চলে জীবন-জীবিকা।
এখানে ফিস বারবিকিউ এর মধ্যে জনপ্রিয় টুনা, কোরাল, ইলিশ, চিংড়ি, ছুরি, লইট্টা, চ্যাপা ইত্যাদি। পাশাপাশি জনপ্রিয় কাঁকড়া ফ্রাই। বড় থেকে ছোট আকৃতিক হরেক কাঁকড়া রাখা হয়েছে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী। আকার অনুযায়ী কাঁকড়ার দামের ভিন্নতা রয়েছে প্রতিটি দোকানে। মাছ এর দাম রাখা হয় ওজনের ওপর ভিত্তি করে। এরপর গ্রাহকের সামনেই পছন্দ করা মাছ বা কাঁকড়া ফ্রাই বা বারবিকিউ করে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর এসব দোকানগুলোতে ভিড় জমে ওঠে।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে মাছ ফ্রাইয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকানের মালিক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ফিশ ফ্রাই বা কাঁকড়া ফ্রাই করে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন। এক দশক আগেও এসব খাবারের চাহিদা ছিল না। এখন পর্যটকদের মধ্যে এ ধরনের খাবারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে ব্যবসাও বেড়েছে।
কক্সবাজারে গেলেই পর্যটকরা ঢুঁ মারেন সৈকতের ঝিনুক-শামুকের দোকানগুলোতে। কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকূলীয় পয়েন্টে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে ৫০ থেকে ৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক। এগুলো দিয়ে তৈরি হয় মালা, দুল, পুতুল, চুড়ি, ব্রেসলেট, ক্লিপ, ওয়ালমেট, ল্যাম্পশেড ও ঝাড়বাতি। আবার বড় সাইজের শামুকের ওপর অঙ্কন করার ব্যবস্থাও আছে।
সুগন্ধ্যা পয়েন্টের ঝিনুক ব্যবসায়ী রেজাউল বলেন, কক্সবাজার সৈকতে এ পণ্যের ব্যবসায় আছেন প্রায় ৬০০ মানুষ। তবে প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এ ব্যবসা জমজমাট চললেও অন্য সময়ে পর্যটক কম থাকায় সংকটে পড়তে হয়। এক বছর আগেও সৈকতে শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন আয় হতো অন্তত পাঁচ হাজার টাকা। এখন প্রতিদিন আয় হয় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা।
এছাড়া সমুদ্র সৈকতে নানা পণ্য নিয়ে ব্যবসা করেন অসংখ্য হকার। এসব হকারদের ৯০ শতাংশই শিশু। এসব হকার সৈকতে কড়ি, শামুক বা ঝিনুকের তৈরি মালা, কানের দুল, ব্রেসলেট বিক্রি করে। আবার অনেকের রয়েছে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। সেখানে তারা সিদ্ধ ডিম, ঝালমুড়ি, ডাব, চা, কফি, খাবার পানি বিক্রি করে। কিছু শিশু পর্যটকদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ম্যাসাজ করেও আয় করে।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টে শামুক-ঝিনুকের তৈরি মালা বিক্রি করেন শিশু নাহিদুল ইসলাম। সে বলে, খুব ভোরে এসে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা শামুক, ঝিনুক ও কড়ি কুড়িয়ে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মালা ও দুল তৈরি করে সৈকতে বিক্রি করতে নিয়ে আসি। এসব পণ্য বিক্রির পাশাপাশি পর্যটকদের মাথা, হাত-পা ম্যাসাজ করি। আধা ঘণ্টা ম্যাসাজ করলে ২০ টাকা পাই। ম্যাসাজ করে দৈনিক দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা পাই।
সম্পাদক ও প্রকাশক
এ এম জি ফেরদৌস
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
নাহিদুল ফাহিম
প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা
ইঞ্জিনিয়ার কে এম মেহেদী হাসান |
প্রধান কার্যালয়
পূর্ব লিংক রোড, ঝিরংঝা, কক্সবাজার
মোবাইল
০১৮১৯-৫০২-৩২২
ই-মেইল
beachnews24@gmail.com |
প্রিন্টের তারিখ ও সময়: October 3, 2023, 11:07 am