কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৭৭ অপহরণকারী সক্রিয়

  বিশেষ প্রতিনিধি    20-01-2023    189
কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৭৭ অপহরণকারী সক্রিয়

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা উদ্যোগ নিয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। মাদক কারবারের পাশাপাশি অপহরণ করে চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রায় প্রতিদিনই অপহরণের ঘটনা ঘটছে ক্যাম্পগুলোতে। গত এক মাসে অন্তত দুই শতাধিক লোককে অপহরণের পর চাঁদা আদায় করা হয়েছে। ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও তৎপর। ইতিমধ্যে অপহরণকারী চক্রের একটি তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। তালিকায় ২৭৭ অপহরণকারী সক্রিয় থাকার কথা বলা হয়েছে। তারা সবাই রোহিঙ্গা।

স্থানীয় একটি চক্রও এই অপহরণকারীদের সহায়তা করছে বলে পুলিশের ওই প্রতিবেদন বলা হয়েছে। তাদের মূল টার্গেট স্থানীয় কৃষক ও ক্যাম্পের ভেতরে থাকা নিরীহ লোকদের ওপর। অপহরণের ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজনকে আটকের পর পুলিশ এসব তথ্য পেয়েছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের একটি চক্র অপহরণ করাসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তাদের কঠোরভাবে দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপহরণকারীদের নিয়ে কিছুদিন আগে একটি প্রতিবেদন এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরে। স্থানীয় একটি মহল অপরাধী রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সহায়তা করছে। তারা স্থানীয় কৃষকদের অপহরণ করছে। আবার ক্যাম্পের ভেতরেও একই ধরনের অপরাধ কর্মকা- চালাচ্ছে। তালিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের ধরতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করেছে।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) কক্সবাজার সফর করেছেন। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সব ধরনের অপরাধ নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছেন। মিয়ানমারের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কিছু সদস্য ক্যাম্পের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আনরেজিস্টার-২১, হোয়াইংকা চাকমারকুল, উংচিপ্রাং ২২, লেদা-২৪, আলী-খালী-২৫, নয়াপাড়া মৌচনী-২৬ ও জাদিমুড়া ক্যাম্পসহ ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে তারা। ভাষানচর ক্যাম্পেও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আশ্রয় নেওয়ার কিছুদিন পরই রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অংশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তারা মাদক কারবার ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটাতে শুরু করে। তাছাড়া আছে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের আছে নানা তৎপরতা। ক্যাম্পগুলোতে অপহরণকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ।

পুলিশ সূত্র জানায়, মাসখানেক আগে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন স্থানীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তালিকায় থাকা সদস্যদের মধ্যে ২ নম্বর ক্যাম্পের কথিত কমান্ডার মৌলভী আয়াছ, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, মোহাম্মদ ফরিদ, ইউসুফ, জামাল, আরমান, বাইল্লা, ক্যাম্প ফরিদ, মো. মুছা, সানাউল্লাহ, সালাম, ছলিমউল্লা, মৌলভী ছামছু, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, ফরিদ, ইউছুফ, জামাল, সলিম উল্লাহ, মৌলভী সামছু, ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরমান, আব্দুল মালেক, আব্দুল হালিম, মাস্টার সাইফ উদ্দিন, ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সিরাজ, এনাম মাস্টার, হোসেন, ইলিয়াছ, নুর, সালাম, হাসিম মৌলভী হামিদ হোছন, নূর বশর, সেলিম, মাস্টার ফারুক, মাঝি আব্দুর ছবি, হাফেজ আয়াছ, লতিফ আলী, মাঝি সাইফুল্লাহ, ওসমান, হবির আহম্মদ, আইয়ুব, মোহাম্মাদ রফিক, ৭ নম্বর ক্যাম্পে আব্দুল মাবুদ, আইয়াছ উদ্দিন, হাফেজ, কেফায়েত উল্লাহ্, হয়দার লেংড়া হায়দার, ৫ নম্বর ক্যাম্পে ভুট্টু আব্দুল্লাহ, ওস্তাদ খালেক মাস্টার এনাম, হাবিবুল্লাহ, সাব মাঝি (ক্যাম্পের উপপ্রধান) সৈয়দুল আমিন, শাহ আলম, কালা মিয়া, মৌলভী হোসেন আহাম্মেদ, মৌলভী নুরুল আমিন, নুর সাফা, লিয়াকত আলী, এহসান উল্লাহ, মাস্টার মুন্না, শামসুল আলম, মো. জাফর, মুছা, মো. জাবেদ, মাস্টার দিল মোহাম্মদ, নবী হোসেন, নুরুল আমিন, সৈয়দুল ইসলাম, নুরুল আমিন, নুর কামাল, জাফর আলম প্রমুখ।

টেকনাফের এপিবিএন-১৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুন উর রশিদ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পারিবারিক সহিংসতা ছাড়াও মাদক, অস্ত্র, ছিনতাই, অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনা বেশি ঘটছে।

সূত্র জানায়, গত এক মাসে ২শ’র বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তারা অপহরণের পর নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে। পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে ১৩৫ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ক্যাম্পে।

গত সপ্তাহে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমারকুল ২১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের বাসিন্দা আমির হাকিমের ছেলে মোহাম্মদ ফরোয়াজ, তার ভাই মোহাম্মদ জোহার, মোহাম্মদ ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ নূর, আবুল হোসেনের ছেলে নুরুল হক, ইউছুফ আলীর ছেলে জাহিদ হোসেন ও আব্দুস সালামের ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিসকে অপহরণ করা হয়। তারা ৫ লাখ টাকা মুুক্তিপণ দাবি করে। প্রায় ২১ ঘণ্টা পর অপহৃতদের স্বজনরা ৩ লাখ টাকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনে। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মোহাম্মদ বেলাল নামে রোহিঙ্গা অপহরকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে ১৯ ডিসেম্বর অপরহরণকারীরা টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ উল্লাহ, মোস্তফা কামাল, করিম উল্লাহ, মো. রিদুয়ান, সলিম উল্লাহ, নুরুল হক, নুরুল আবছার ও নুর মোহাম্মদকে অপহরণ করা হয়। ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। পুরো টাকা দিয়েই তারা মুক্ত হন।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় এখন অপহরণের ঘটনা বেশি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অপরাধ রুখতে ক্যাম্পগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও রাস্তা নির্মাণের কাজও শেষের দিকে আছে। ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত পুলিশের পাশাপাশি এপিবিএনের তিনটি ইউনিটের ১৯২৪ জন সদস্য মোতায়েন রয়েছেন।

উল্লেখ্য, বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে ১১ লাখের বেশি আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ বনভূমি ও পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তারা গাছ কাটার মাধ্যমে বনভূমি হ্রাস এবং এলাকার পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর ৪৫ হাজারের বেশি শিশুর জন্মগ্রহণ করছে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দিয়েছে। সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়ার জন্য ভাসানচরকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তুলেছে।

সারাদেশ-এর আরও খবর