ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কে হারাচ্ছে ভালোবাসার বন্ধন

  বিশেষ প্রতিনিধি    14-02-2023    199
ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কে হারাচ্ছে ভালোবাসার বন্ধন

আজ পয়লা ফাল্গুন। একই সঙ্গে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। একই দিনে দুই আয়োজনে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই বিনোদনপ্রেমীদের। বিশেষ করে এসব দিন সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে প্রেমিক যুগল ও তরুণ-তরুণীরা। রং-বেরঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি ও ফুলে ফুলে সেজে তারা বেরিয়ে পড়েন চারদিকে বসন্ত-ভালোবাসাকে বরণ করে নিতে। তবে এত আনন্দ আর বিনোদনের পরও সম্পর্কের গভীরতায় পৌঁছাতে পারছে না নতুন প্রজন্ম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভার্চ্যুয়ালি যোগাযোগ, অতি উচ্ছ্বাস, অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও অতি-আবেগের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে এসব সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না মানবিক সম্পর্ক ও ভালোবাসার বন্ধন।

সরেজমিনে মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেহরাজ ও ফায়জা নিশাত তিন বছরে ধরে সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। ফায়জা বাসন্তী রঙের শাড়ি আর মেহরাজ সাদা রঙের পাঞ্জাবির সঙ্গে লাল কুটি পরে ভালোবাসা দিবস আর বসন্তকে বরণ করতে সকাল সকাল এসেছেন ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। বিশেষ দিনটিকে ঘিরে লেকের পাড়ে বসেন এই প্রেমিক যুগল। তারা সম্পর্কের নানা মাত্রিক বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলেন।

ফায়জা নিশাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বাস, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার ওপরই তো যেকোনও সম্পর্ক টিকে থাকে। বর্তমানে আমাদের পরিচিতজনদের মাঝেই অথবা চারপাশে আমি যেটি দেখেছি, অনেকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মানটা রাখে না। সামান্য বিষয় নিয়ে একজন আরেকজনকে সন্দেহ করে, গালাগালি করে; গায়ে হাত পর্যন্ত তোলে। আমি তার কাছ থেকে এমনটা কখনো দেখিনি। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া অন্য রকম। এককথায় যদি বলি, আমাদের সম্পর্কের মাঝে শ্রদ্ধা ও সম্মানটা রয়েছে, যেখানে আমরা দুজনই একমত।’

তবে কিছুটা ভিন্ন সুরে কথা বললেন মেহরাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা সারা দিন কত কিছু করি। কর্মব্যস্ততা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। পারিবারিকভাবে কত কিছু করা হয়। তবে সবকিছু শেষে একটা বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি, দিন শেষে আমি যখন আমার এ মানুষটির সঙ্গে কথা বলি, তখন আমার মাঝে যে অনুভূতি তৈরি হয়, সেটা আমি আর কোথাও খুঁজে পাই না।’

সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজে হোমিওপ্যাথিক বিভাগে শেষ বর্ষে ছিলেন সাব্বির আহম্মেদ। শেষ দিকে এসে পরিচয় হয় একই বিভাগের শিক্ষার্থী মার্জিয়ার সঙ্গে। ফেসবুকে কিছুদিন কথা বলার পর দুজনে জড়ান প্রেমের সম্পর্কে। তিন বছর পর প্রেম করে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন তারা। ফাগুন ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে অন্যদের মতো তারাও বের হয়েছেন ঘুরতে। সাব্বির-মার্জিয়া দম্পতির সঙ্গে কথা হয় ধানমন্ডি রবিন্দ্র সরোবরে।

মার্জিয়া বলেন, ‘আমাদের প্রথম পরিচয় হয় ফেসবুকে। তারপর অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কাছাকাছি আসি। একটা সময় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে পারিবারিকভাবে একটু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। দুজনের বাড়ি গাজীপুর ও কুষ্টিয়া হওয়ায় দূরত্বের কারণে দুই পরিবারই পিছিয়ে ছিল। দুপক্ষের প্রধান আপত্তি, দুই পরিবারের সংস্কৃতি মিলবে না। আমাদের বিয়ে হয়েছে এক বছর। অথচ এমনটা কখনোই হয়নি। কারণ আমাদের বোঝাপড়ার মধ্যে কোনও ঝামেলা নেই।’

এ প্রসঙ্গে সাব্বির বলেন, ‘যখন মনের মিল একবার হয়ে যায়, তখন যত বাধাই আসুক, জয়ী হওয়া যায়। এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতি সবখানেই আছে। এসবের জন্য অনেক উচ্চশিক্ষিত লোকজনের দীর্ঘদিনের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। আমি বলবো, দুজনকে ছাড় দিতে হবে। দুই পরিবারকেও ছাড় দিতে হবে। চাওয়া-পাওয়াটা বুঝেশুনে হতে হবে। প্রত্যাশা বেশি করা যাবে না। এতে সম্পর্কের অবনতি হয়। আমি মনে করি শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া আর ছাড় দেওয়ার মানসিকতার মধ্য দিয়ে ভালোবাসা টিকে থাকে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. মেখলা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে অধিকাংশ সম্পর্ক ভার্চ্যুয়ালি হওয়ায় সম্পর্কগুলো একটি বেড়াজালে আটকে আছে। একজনকে সরাসরি দেখে যতটা জানতে পারা যায়, ভার্চ্যুয়ালি সেটি কখনও সম্ভব নয়। ফলে অনলাইনে সম্পর্ক তৈরি করে ওপর পাশের মানুষটিকে নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়েছেন, তাকে নিয়ে আপনি ভাবনার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছেন; পরে যখন বাস্তবে তার বিপরীত হচ্ছে, শর্ট টাইমেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

ডা. মেখলা আরও বলেন, ‘পারিবারিকও একটা শিক্ষা আছে। এখনকার বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা একটি কক্ষের ভেতর ডিভাইস হাতে বড় হচ্ছে। তারা মাঠে খেলতে যাচ্ছে না। তারা মানুষের সঙ্গে মিশছে না। তারা সারাক্ষণ একটি গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। ফলে তারা যেভাবে বেড়ে উঠছে, বাস্তব জীবনে সেটাই ব্যবহার করছে। তারা কিছু চাওয়ার আগেই বাবা-মা তা পূরণ করে দিচ্ছেন। এখন দেখা গেছে, একটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই প্রজন্ম দীর্ঘ জার্নি পছন্দ করছে না। তাদের ধৈর্যক্ষমতা কম। ফলে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাদের ধৈর্য নেই। হুটহাট প্রিয়জনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে, সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে।’

সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির একটা ব্যাপার তো আছেই। এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতি আছে। এক এলাকার ক্ষেত্রে অন্য এলাকার সংস্কৃতি না-ও মিলতে পারে। সম্পর্ক ও বিয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে বলে মনে করেন ডা. মেখলা সরকার।

সারাদেশ-এর আরও খবর