চট্টগ্রাম পাহাড়ে দুই যুগে ২৫৯ প্রাণহানি

  বিশেষ প্রতিনিধি    10-04-2023    92
চট্টগ্রাম পাহাড়ে দুই যুগে ২৫৯ প্রাণহানি

চট্টগ্রামের পাহাড়ে গত দুই যুগে পাহাড় ধসে প্রতি বছর গড়ে ১১ জন মারা গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ মনুষ্য সৃষ্ট কারণে পাহাড় ধস ও প্রাণহানি এড়াতে দীর্ঘ এ সময়ে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত ‘শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। এর অন্যতম ছিল পাহাড় কাটা বন্ধ করা। এ পর্যন্ত কমিটি ২৬টি সভা করেও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারেনি। ফলে থামছে না পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল।

জানা গেছে, নগরে অতীতে সংঘটিত পাহাড় ধসের বেশিরভাগই ঘটেছে ভারী বর্ষণের পর। অথচ কোনো বৃষ্টি ছাড়াই গত শুক্রবার আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনায় পাহাড় ধস হয়েছে। এর কারণ ছিল পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করা। অর্থাৎ পাহাড় কাটার সঙ্গে ধসের বিষয়টি এখানে স্পষ্ট হয়েছে। অবশ্য অতীতেও যেখানে পাহাড় ধস হয়েছে সেখানে পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাহাড় কাটার ফলে ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়, গাছপালার আচ্ছাদন বিনষ্ট হয়, মাটির দৃঢ়তা হ্রাস পায় এবং বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করে। এতে পাহাড় ধস হয়।’ চট্টগ্রাম জেলায় অবৈধ বাসস্থান নির্মাণ, ইটভাটায় মাটি ব্যবহার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যই এ পাহাড় কাটা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে ছোট ছোট বসতি স্থাপনের মাধ্যমে প্রথমে পাহাড় দখল করা হয়। এরপর পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয় বসতি। পরে সুবিধাজনক অংশে এবং পাহাড়ের বিভিন্ন বসতির অন্তরালে বিরামহীনভাবে চলে পাহাড় কাটা। একসময় সেই অংশে পাহাড় কাটা শেষ হলে বসতি অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও ভিন্ন পদ্ধতিতেও পাহাড় কাটা হচ্ছে। নির্দিষ্ট পাহাড় কাটার পূর্বে প্রথমে এর কিছু অংশে ৯০ ডিগ্রি খাড়াভাবে কাটা হয়। তারপর যেসব পাহাড় খাড়াভাবে কাটা হয়েছে তার চূড়ায় কিছু দূর অন্তর অন্তর খালের মতো করে কেটে ফেলা হয়, যাতে বৃষ্টির পানিতে পাহাড়ের মাটি সহজেই ধসে পড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী ১২ বছরে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় নিধন। এ সময় বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর ও ফয়’স লেকে। এর আগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩২ বছরে নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়।

গত ৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া পাহাড় কাটা বন্ধে জোর দেয়া হয়।

কবে থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, শীঘ্রই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে কার্যক্রম শুরু করা হবে। তিনি বলেন, একমাত্র পাহাড় কাটার কারণেই বর্ষা না থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় কাটা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবার ‘এটেনশন’ লাগবে। দুর্ঘটনা রোধ এবং পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে স্থায়ী কী উদ্যোগ নেয়া যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সবাইকে সচেতন হতে হবে। একার পক্ষে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব না।

দুই যুগে ২৫৯ প্রাণহানি : সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনায় মারা যায় একজন। এর আগে গত বছরের ১৭ জুন দিবাগত রাতে নগরের আকবর শাহ থানার পৃথক দুটি স্থানে পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় দুই পরিবারের চারজন। এর মধ্যে ফয়স’ লেক সী ওয়ার্ল্ডের পাশে বিজয় নগরে দুজন এবং বরিশাল ঘোনা এক নম্বর ঝিলে মারা যায় দুজন। একই বছরের ২০ জুন পাঁচলাইশ থানার চশমা হিলের গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসে এক কিশোর প্রাণ হারায়।

২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর দিবাগত রাত ২টায় আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিনজন এবং রহমান নগরে দেয়াল ধসে মারা যায় একজন। ২০১৭ সালের ২১ জুলাই সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছিল একই পরিবারের পাঁচজন। একই বছরের ১২–১৪ জুন ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ২৭ জন এবং চন্দনাইশে ৪ জন ছিলেন।

২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ মাঝের ঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান একই পরিবারের দুজন। ভোর ৭টার দিকে পাহাড় ধসে নিহত দুজন সম্পর্কে ছিলেন মা–মেয়ে। একই বছরের ১৮ জুলাই ঈদুল ফিতরের রাতে আধ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুটি স্থানে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ৫ শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছিল ৬ জন। এর মধ্যে রাত ২টার দিকে বায়েজিদ থানার আমিন কলোনির শাহাজাহান মিস্ত্রির ঘরে পাহাড় ধসে তিন ভাই–বোন এবং এর আগে রাত দেড়টার দিকে লালখান বাজারের পোড়া কলোনি এলাকায় দেয়াল ধসে মা–মেয়েসহ মারা যায় ৩ জন।

২০১৩ সালের ২৮ জুলাই ভোর সোয়া ৫টার দিকে লালখান বাজারের টাংকির পাহাড়ে ধসের ঘটনায় মা–মেয়ের মৃত্যু হয়েছিল। একই বছরের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানার ইস্পাহানি গোল পাহাড় সি–গেইট এলাকায় সাহারা খাতুন নামে এক গৃহবধূ মারা যায়।

২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর চার স্থানে পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় ১৮ জন। ২০১১ সালের ১ জুলাই বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে পড়লে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে ১৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট মতিঝর্ণায় পাহাড় ধসে মারা যায় ১১ জন। ২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর সাতটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণ হারায় ১২৭ জন।

এর আগে ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট সিআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড় ধসে মারা যায় ১০ জন। পরের বছর ২০০০ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকাসহ নগরীতে সংঘটিত আরেকটি পাহাড় ধসে মারা যায় ১৩ জন।

উল্লেখ্য, ২০০৯, ২০১০, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেনি। ২০১৯ সালে পৃথক দুটি স্থানে ধস হয়েছিল। এছাড়া টানা বর্ষণের ফলে ২০১৪ সালের ২০ জুন পৃথক তিনটি স্থানে ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চেরাগী পাহাড় রাজাপুকুর লেনের দয়াময়ী কলোনিতে পাহাড় ধসে চারজন আহত হয় এবং প্রবর্তক মোড় ও টাইগারপাসে ধসের ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও আশেপাশের লোকজনের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।

সারাদেশ-এর আরও খবর