বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র থেকে জঙ্গি নেতা শামিন

জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া

  বিশেষ প্রতিনিধি    18-10-2022    170
বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র থেকে জঙ্গি নেতা শামিন

শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন স্যার ওরফে মেন্ডিং মুরং। ছাত্রজীবনে ছিলেন মেধাবী। এসএসসি ও এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণি পেয়ে। ২০০৩ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। শিক্ষকতা করেন ২০১১ সাল পর্যন্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুমি সম্প্রদায় নিয়ে পিএইচডি গবেষণায়ও নিযুক্ত হন। থাকা শুরু করেন পাহাড়ে। এসময় জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি কার্যক্রমে। সংগ্রহ করতে থাকেন সদস্য। এক পর্যায়ে নিজেই গড়ে তোলেন নতুন জঙ্গি সংগঠন। নাম দেন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে দুবার গ্রেফতার হন শামিন। সবশেষ গ্রেফতার হন ২০১৪ সালে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ২০১৭ সালে জামিনে বের হওয়ার পর থেকেই লাপাত্তা। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি)- এসব সংগঠন থেকে সদস্য এনে নতুন জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে শামিনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নেতা সাবেক শিক্ষক শামিন মাহফুজ। তাকে গ্রেফতারে বেশ কয়েকদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতার করলে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনে কারা যুক্ত রয়েছেন এবং কারা অর্থ জোগান দিচ্ছেন- এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, শিক্ষক হওয়ায় উগ্রপন্থিরা তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। তার আরেক নাম ‘মেন্ডিং মুরং’। পার্বত্য এলাকায় জঙ্গি কার্যক্রমের সময় সংগঠনের সদস্যদের কাছে এই নামে বার্তা আদান-প্রদান করেন। শামিনের বিরুদ্ধে বান্দরবানের থানচি ও যাত্রাবাড়ী থানায় পাঁচটি মামলা থাকার তথ্য মিলেছে। পাহাড়ে প্রশিক্ষণ, ভারী অস্ত্র সংগ্রহসহ জঙ্গি সংগঠনের মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক। পাহাড়ি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা এক জঙ্গির কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে ওই তরুণের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল আনসারের শীর্ষ নেতাদের ধরতে অভিযান শুরু হয়েছে। সম্প্রতি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নতুন করে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণরা জামাআতুল আনসারের হয়ে পাহাড়ি এলাকার আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব আস্তানায় হিজরত করা তরুণদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সম্প্রতি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় হিজরতের নামে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র‌্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য কোথাও নেই। তবে এটা শামিন মাহফুজের ‘ব্রেনচাইল্ড’ হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। তার সঙ্গে আছে মূলত হুজিবির লোকজন। তবে অন্য জঙ্গি সংগঠনের দলছুট অনেকে এই গ্রুপে যুক্ত হতে পারে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। দেশের পার্বত্য অঞ্চলে হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া সংগঠনটি এখন ভয়ঙ্কররূপে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করার নীলনকশাও বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। র‌্যাব জানায়, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। বিভিন্ন সময় ঘরছাড়া অনেক তরুণ পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা উগ্রপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করছে গোপনে। জঙ্গিদের ধরতে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে সম্মিলিত অভিযান। পাহাড়ে সক্রিয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জাগো নিউজকে জানায়, নতুনভাবে উগ্রপন্থিদের চাঙা করতে নেপথ্যের অন্যতম প্রধান কারিগর শামিন মাহফুজ। ২০১৮ সালে শামিন আনসার আল ইসলামের একজন শীর্ষ নেতা মাইনুল হাসান রক্সির সঙ্গে নতুন সংগঠন করার জন্য কাজ শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা গাইবান্ধার বাসিন্দা শামিন গবেষণার নামে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করেন পাহাড়ি এলাকায়। ২০১১ সালেও বান্দরবানে জিহাদি বইপত্রসহ বিজিবি তাকে একবার গ্রেফতার করেছিল। সেসময় তিনি পাহাড়ে জমি বরাদ্দ নিয়ে কৃষি খামারের আড়ালে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করেছিলেন। জামিনে বের হয়ে এসে তিনি ফের নতুন উদ্যমে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাতে থাকেন। জানা যায়, ছাত্রজীবন থেকেই শামিন মেধাবী। তবে তার মেধাকে ভালো কাজে না লাগিয়ে খারাপ কাজে ব্যবহার করতেন। ছাত্রশিবিরে যুক্ত হওয়ায় রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন তিনি। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি হিজরতকারীদের কাছ থেকে এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন, যা দেখে তারাও বিস্মিত। নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক শামিন মাহফুজের সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকাভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ প্রধান বম মাথানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। ভিন্ন বিভাগ হলেও বম মাথান ও শামিন মাহফুজ একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেই সূত্র ধরে বম মাথানের সহযোগিতা নিয়ে পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গড়ে তুলেছেন শামিন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে সিনিয়র সদস্যের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা আনসার হাউজ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় বান্দরবানে কেএনএফের ক্যাম্পে। ক্যাম্পে এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জামাতুল আনসার কতটা ভয়ংকর? জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য কোথাও নেই। তবে এটা শামিন মাহফুজের ‘ব্রেনচাইল্ড’ হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। তার সঙ্গে আছে মূলত হুজিবির লোকজন। তবে অন্য জঙ্গি সংগঠনের দলছুট অনেকে এই গ্রুপে যুক্ত হতে পারে। এটি অনেকটা নতুন বোতলে পুরোনো মদের মতো। লোক সব পুরোনো, তবে নামটা নতুন। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল দীর্ঘদিন জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, কয়েক বছর ধরে জঙ্গিরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন জঙ্গি মতাদর্শের লোক থাকে। অনেক সময় তারা নতুন কোনো নাম ধারণ করে। তবে তারা কেউই ভয়ংকর কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। নিরাপত্তাজনিত কারণে রুমা ও রোয়াংছড়িতে ভ্রমণে বিরত থাকার নির্দেশ নিরাপত্তাজনিত কারণে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত পর্যটকদের ভ্রমণ স্থগিত করা হয়েছে। দুই উপজেলায় সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে সোমবার (১৭ অক্টোবর) রাতে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান। পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা কেন জানতে চাইলে রোয়াংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খুরশীদ আলম চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কয়েকদিন ধরে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম বড়থলি ইউনিয়ন এবং ওই ইউনিয়নসংলগ্ন রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলছে। ওই অভিযানের স্বার্থে দুই উপজেলায় পর্যটকদের ভ্রমণ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। জানতে চাইলে সিটিটিসি’র প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নেতা সাবেক শিক্ষক শামিন মাহফুজ। তাকে গ্রেফতারে বেশ কয়েকদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতার করলে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনে কারা যুক্ত রয়েছেন এবং কারা অর্থ জোগান দিচ্ছে- এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।সূত্রঃ জাগোনিউজ

জাতীয়-এর আরও খবর