আলেকজান্ডার ক্যাসেল ঘিরে কেন সীমানা প্রাচীর?

  বিশেষ প্রতিনিধি    29-08-2022    83
আলেকজান্ডার ক্যাসেল ঘিরে কেন সীমানা প্রাচীর?

ময়মনসিংহের প্রাচীন স্থাপনাসমূহের মধ্যে অন্যতম আলেকজান্ডার ক্যাসেল বা লোহার কুঠির। সম্প্রতি ময়মনসিংহের গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল কর্তৃপক্ষ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির সামনের মাঠে নিজেদের স্কুলের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করে। স্কুলের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের দাবি করা হয়েছে। তবে এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং একই এলাকার অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের মতে দেয়াল তুলে ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সৌন্দর্য নষ্ট করা হবে। পাশাপাশি স্কুলের সামনের মাঠটি অন্য প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয়রা ব্যবহার করতে পারবে না। তারা সীমানা দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। জানা যায়, ১৮৭৯ সালে মহারাজা সুকান্ত সুর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তিতে বাংলো আদলের সুরম্য বাগানবাড়িতে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মাণ করে বিশেষ একটি ভবন। তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম অ্যাডওয়ার্ডের পত্নী আলেকজান্দ্রার নাম অনুসারে ভবনটির নাম করা হয় ‘আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল’। তবে স্থানীয়ভাবে ভবনটি আলেকজান্ডার ক্যাসেল বা লোহার কুঠির বলে পরিচিতি। মহারাজার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর বিদেশি অতিথিদের থাকার জন্য এটি ব্যবহার হতো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহে এসে এ ভবনটিতে থেকেছিলেন। পরবর্তীতে জমিদারি প্রথা উঠে গেলে ১৯৪৮ সালে ক্যাসেলের এই বাগান বাড়ির সীমানায় ২৭ দশমিক ১৫ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহ টির্চাস ট্রেনিং কলেজ। বর্তমানে এ সীমানার ভেতর রয়েছে শিশু কানন কিন্ডার গার্টেন, ময়মনসিংহ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ মোট সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। একটি সীমানা প্রাচীরের ভেতর সাতটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এ জমিটি এখনও খাস জমি হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লোহার কুঠিরের সামনে স্কুলের মাঠ বরাবর ইটের গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে। এই মাঠটি খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করে শিশু কানন কিন্ডার গার্টেন, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। একই মাঠে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। বিকাল হলে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আলেকজান্ডার ক্যাসেল দেখার জন্য ভিড় জমান। এছাড়া স্থানীয় কিশোররাও মাঠটি খেলাধুলার কাজে ব্যবহার করে। এ বিষয়ে ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা বলেন, একই সীমানায় পাশাপাশি সাতটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও আমাদের স্কুলে ছোট ছোট অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। একই মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে বহিরাগতরা দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করে। বেপরোয়া চলাচলে বিভিন্ন সময় স্কুল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আহত হয়েছেন। এছাড়া কোনও নিরাপত্তা বেষ্টনি না থাকায় স্কুলের ছাত্রীদের নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া রাতে স্কুলের পেছনে মাদকাসক্তদের আড্ডা হয়। এসব কারণে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কর্তৃপক্ষের মতামত নিয়েই মাঠের পাশে গাইডওয়াল নির্মাণ করে তার ওপর গ্রিল দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও জানান, কাজ শুরুর পর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কৃর্তপক্ষ কাজ বন্ধ রাখার কথা জানায়। এরপর নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসক বরাবর এই বিষয়ে আবেদন করা হয়েছে। তিনি শিগগিরই বিষয়টি সমাধানে সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসার আশ্বাস দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. জয়নাল আবেদীন খান বলেন, সুকান্ত সুর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর সুরম্য বাগানবাড়িতে ১৯৪৮ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীতে এই জায়গায় সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ক্যাম্পাসের ভেতর শিক্ষার্থীদের হোস্টেল, শিক্ষক কর্মচারীদের বাসভবন, খেলার মাঠ, পুকুর, মসজিদসহ অনেক ছোট বড় খালি জায়গা রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ময়মনসিংহ গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে খেলার মাঠের প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু করে। এতে ঐতিহাসিক লোহারকুঠির সৌন্দর্যহানি হবে। একইসঙ্গে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের স্টাফসহ এই ক্যাম্পাসে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লোকজনের চলাচলেও বাধা সৃষ্টি হবে। তিনি আরও বলেন, সাতটি প্রতিষ্ঠানের মাঠটিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে করে ভাগ করে নেওয়া মানসিকতা ঠিক নয়। আমরা কখনও সীমানা প্রাচীরের পক্ষে মত দেইনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাচীর নির্মাণ করতে চাইলে আমি বলেছি সড়কটির গতিরোধক করা যেতে পারে। তবে কখনও সীমানা প্রাচীরের পক্ষে বলিনি। এদিকে লোহারকুঠিরের সামনের মাঠ কেবল স্কুলের সম্পত্তি নয়, বরং স্থানীয় বাসিন্দাদেরও তাতে অধিকার আছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা। সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা প্রাচীর দিয়ে মাঠ ঘিরে ফেলার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ বলেন, আলেকজান্ডার ক্যাসেল একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই স্থাপনার সামনের মাঠে প্রাচীর নির্মাণ করার কোনও যুক্তি নেই। এতে করে ঢাকা পড়বে ঐতিহাসিক স্থাপনাটি। দর্শনার্থীদের কাছে এই স্থানটির মূল্য কমে যাবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে খোলা মাঠে যে প্রাচীর নির্মাণ করছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বরং এই স্থানটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সীমানা প্রাচীর নির্মাণ বন্ধ না হলে নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, লোহার কুঠিরকে ঘিরে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে নিয়ে একটি বড় সীমানা প্রাচীর আগে থেকেই আছে। এরপর আবার নতুন সীমানা প্রাচীর করে স্কুলকে আলাদা করা হলে ঐতিহ্যবাহী লোহার কুঠিরের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। পর্যটকদের আকর্ষণ হারাবে। তিনি আরও বলেন, লোহার কুঠিরের সামনের মাঠটি অবশ্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। এখানে শহরের মানুষ ঘুরতে আসে, কিশোর-তরুণরা খেলাধুলা করে। এটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে স্কুলের বিশেষ কোনও লাভ হবে বলে মনে করি না। কিন্তু বঞ্চিত হবে শহরবাসী। এ মাঠকে যে কোনও মূল্যে উন্মুক্ত রাখা জরুরি। নিরাপত্তার ইস্যুতে কোনোভাবেই খোলা মাঠে প্রাচীর নির্মাণ করা উচিত নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট না করে স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত অন্য উপায়ে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সীমানা প্রাচীর নির্মাণের বিষয়টি শুনে তা বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে। পরবর্তীতে এ সীমানায় অবস্থিত সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে সিন্ধান্ত নেওয়া হবে।

সারাদেশ-এর আরও খবর