কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সংকট : জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নতুন প্রস্তাব

  বিশেষ প্রতিনিধি    18-01-2023    200
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সংকট : জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নতুন প্রস্তাব

বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমশ পরিবর্তন হচ্ছে। কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বত্র। ফলে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের নতুন প্রস্তাব রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি পশ্চিমাদের নজর অনেকটা ফেরালেও তা ধরে রাখাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের আলোকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে ফলোআপ হিসাবে বাংলাদেশকে আরও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গত ২১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রস্তাব (নম্বর ২৬৬৯) অনুমোদিত হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর দেশটির মুক্ত হাওয়া রুদ্ধ হয়ে যায়। গণতন্ত্রের আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের আনাগোনা। আর এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ নিরাপত্তা পরিষদের নতুন প্রস্তাবে। চার মাস আলাপ-আলোচনার পর যুক্তরাজ্য প্রস্তাবটি পেশ করে। প্রস্তাবের পক্ষে ১২ ভোট পড়েছে। বিপক্ষে কোনো ভোট পড়েনি। চীন ও রাশিয়া এবার ভেটো প্রয়োগ না করে ভোটদানে বিরত ছিল। ভোটদানে বিরত ছিল ভারতও।

গত সাত দশকে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার সংক্রান্ত এটি প্রথম প্রস্তাব। এর আগে ১৯৪৮ সালে বার্মাকে জাতিসংঘে যুক্ত হওয়া সংক্রান্ত প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়েছিল। এবারের প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশেষভাবে আলোকপাত করায় তা নতুন মাত্রা পেয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ২০০৭ সালে একটি প্রস্তাবে বেইজিং ও মস্কো ভেটো প্রয়োগ করায় তা অনুমোদন হয়নি। তারপর আট লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালেও নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা চলে। ওই উদ্যোগ সফল হয়নি। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের প্রশ্নে বরাবরই বিভক্ত। ফলে ২০০৮, ২০১৭ এবং ২০২১ সালে তিনবার রোহিঙ্গাসংক্রান্ত বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু।

2 নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পরিস্থিতি সংক্রান্ত নতুন প্রস্তাবে রোহিঙ্গা ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, মেক্সিকো, গ্যাবন ও নরওয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছে। রাশিয়া বলেছে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। ফলে এটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। চীনের প্রতিনিধির ব্যাখ্যায় বলা হয়, প্রস্তাব না নিয়ে বরং নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের বিবৃতি দিলেই বেশি কার্যকর হতো। ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি জটিল। এ নিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে কূটনীতি করতে হবে। অন্য কিছু পক্ষগুলোকে নমনীয়তা অবলম্বন থেকে দূরে সরাতে পারে।

আয়ারল্যান্ড প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের প্রতিনিধি বলেছেন, প্রস্তাবই যথেষ্ট নয়। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরও কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ব্যাপারে মালয়েশিয়াসহ অনেক আসিয়ান দেশের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।

প্রস্তাবটির মূল উদ্দেশ্য মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকটের প্রতি আলোকপাত করা। ফলে প্রাথমিক খসড়ায় রোহিঙ্গা সংকটের কথা উল্লেখ করা হয়নি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা সংকটের ওপরও প্রস্তাবে ফোকাস ফেলেছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল মুহিত যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের ওপর এ প্রস্তাব তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি পশ্চিমাদের দৃষ্টিপাত হবে। মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরের বাইরে চলে গিয়েছিল।

তাৎক্ষণিক প্রভাবের মধ্যে আসিয়ানের পাঁচ দফা প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সে বিষয়ে আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব কিংবা তার বিশেষ দূত নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পেশ করবেন। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে আসিয়ানের ভূমিকার প্রতি বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটির প্রিঅ্যাম্বলে পাঁচটি এবং অপারেটিভ প্যারাগ্রাফে চারটি ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রস্তাবটি পাশ হওয়ায় রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমার ইস্যু জাতিসংঘ মহাসচিবের নিয়মিত এজেন্ডায় আলোচ্য হতে পারে। এর আলোকে নিরাপত্তা পরিষদে আরও নতুন নতুন প্রস্তাব পেশ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহির মুখে আনা সম্ভব হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসন না করলে নিরাপত্তা পরিষদ তার ম্যান্ডেটের সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাসংক্রান্ত আরও প্রস্তাব গ্রহণে বাংলাদেশকে নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।

প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়। তাদের নিরাপদে ফেরত পাঠানোর জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

প্রস্তাবটির খসড়ায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরও কড়া ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রস্তাব বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের অংশটি চূড়ান্ত প্রস্তাব থেকে বাদ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের করণীয় সুপারিশ : রোহিঙ্গা ইস্যুকে জীবিত রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশের উচিত হবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করা। বিশেষ করে দুটি আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারকাজ চলাকালে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব নতুন মাত্রা যোগ করবে। তবে এটাকে এখানেই থামতে দেওয়া উচিত হবে না। আরও নতুন নতুন প্রস্তাব আনার ব্যাপারে বাংলাদেশকে উদ্যোগী হতে হবে।

নিউইয়র্ক ও জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনকে আন্তর্জাতিক অংশীদার ও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বেশি করে যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে আসিয়ানে মিয়ানমারসংক্রান্ত এজেন্ডায় রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্ত করতে হবে।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ইউএনএইচসিআর, ও এইচসিএইচআর, ইউএনডিপিসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারে প্রবেশের অনুমতির জন্য কাজ করতে হবে। বিশেষ করে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ১৫ মার্চের মধ্যে যে প্রতিবেদন নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করবেন তাতে রোহিঙ্গা ইস্যুর উপযুক্ত উল্লেখ থাকার জন্য তৎপর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের প্রতি জোর দেওয়া যেতে পারে।

সারাদেশ-এর আরও খবর