রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি তহবিলেও দেখা দিয়েছে সঙ্কট

  বিশেষ প্রতিনিধি    14-03-2023    235
রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি তহবিলেও দেখা দিয়েছে সঙ্কট

বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে আসছে। টান পড়েছে রোহিঙ্গা তহবিলেও। চলতি পহেলা মার্চ থেকে প্রত্যেক রোহিঙ্গার জন্য সহায়তার পরিমাণ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবিক সহায়তার জন্য সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) তথ্য অনুযায়ী, মূলত ২০১৯ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থ সহায়তা। ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিল ৬৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৮৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২২ সালে ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চলতি বছরের শুরু থেকেই কিছু বেসরকারি সংস্থা মানবিক কিছু কর্মসূচি বন্ধ করার বিষয়টি নিজ নিজ কর্মীদের জানিয়েছে। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। কিছু প্রকল্পের জন্য দাতাদের অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণেই বন্ধ হচ্ছে কিছু কর্মসূচি, এমনটা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, তহবিল ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তার পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। চলতি বছরের পহেলা মার্চ থেকে প্রত্যেক রোহিঙ্গার জন্য সহায়তার পরিমাণ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়। এরই মধ্যে তাদের খাদ্য সহায়তাও কমার কারণে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আর রোহিঙ্গারা বলছে, ক্রমান্বয়ে খাদ্য সহায়তা কমায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত স্বদেশে প্রত্যাবাসন করার দাবি জানান রোহিঙ্গা নেতারা।

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের পর কয়েক মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। এর আগে বাংলাদেশে ছিল আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন।

রোহিঙ্গা সংকটের প্রায় ছয় বছরে এসে কক্সবাজারে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার পরিমাণ কমানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা বলছে, ক্রমান্বয়ে খাদ্য সহায়তা কমায় দুশ্চিন্তায় তারা।

উখিয়ার ক্যাম্প-৪-এর রোহিঙ্গা আসমা বলেন, আগে ৫ কেজি চিনি, ৫ কেজি ডাল কিনতে পারতাম। এখন টাকা কমে গেছে, মরিচও কিনতে পারি না।

আরেক রোহিঙ্গা রফিক বলেন, ‘মার্চের আগে ১,২২০ টাকা করে খাদ্য সহায়তা পেতাম। কিন্তু এখন এক হাজার ২০ টাকার খাদ্য সহায়তা পাচ্ছি।

সিরাজ নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, আগে বাংলাদেশের মানুষসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে সহায়তা করত। তখন ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতে পেরেছিলাম। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে খাদ্য সহায়তা যে কমা শুরু করেছে সেটা আর বাড়ছে না।

উখিয়ার কুতুপালংস্থ রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের খরচের পরিমাণ যখন কমে যাচ্ছে, তখন তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে তাদের আয়ের উৎস ঠিক রাখতে চাইবে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর এর বেশ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছি।’

উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, বন ও পাহাড় উজাড় হওয়ার পর খাদ্য সংকটের কারণে বন্যহাতিরা লোকালয়ে হানা দেয়। ঠিক তেমনি, রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা যেভাবে কমছে, তাতে রোহিঙ্গারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয়দের ওপর হামলে পড়ার সমূহ আশংকা রয়েছে।

এদিকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কোনো দেশছাড়া মানুষ না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্যাতন করে আমাদের দেশছাড়া করেছে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে দ্রুত আমাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন করার দাবি জানাচ্ছি।’

রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে ক‍্যাম্পে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্কাসের চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা জানান, উদ্ভুত নিত‍্য নতুন নানা ‘আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে বিভিন্ন দেশের দাতা সংস্থাগুলো এখন রোহিঙ্গা ইস্যুকে প্রাধান্য কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি তারা আর্থিক সহায়তা থেকেও ক্রমশ সরে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের মধ্যে এর একটা বড় প্রভাব তৈরি হতে পারে। এজন‍্য এখনই সম্বলিত প্রচেষ্টায় জাতীয়ভাবে একটি ওয়ার্কশপ হওয়া দরকার। সেখানে পাঁচ বছরের জন্য একটা ফান্ড নিশ্চিত হলে তাহলে এ সমস্যা কিছুটা হলেও মোকাবেলা করা সম্ভব। হয়তো সেখান থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তিনি বলেন রোহিঙ্গারা যদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কক্সবাজার জেলার মানুষ। তখন এর মোকাবিলা করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে। এখনই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা।’

এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. ‘মিজানুর রহমান বলেন, এ পর্যায়ে এসে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হলে রোহিঙ্গারা কাজের খোঁজে আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। তাতে তাদের ক্যাম্পের মধ্যে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তবে সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন করার চেষ্টায় রয়েছে। প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা যাতে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে, সেই ব্যবস্থার জন্য সরকার কাজ করছে। সুত্র, দৈনিক কক্সবাজার

সারাদেশ-এর আরও খবর