‘পদ্মা সব গিলে খেলো’

  বিশেষ প্রতিনিধি    05-11-2022    133
‘পদ্মা সব গিলে খেলো’

হারুন মোল্লার ৩০ বিঘা ফসলি জমি ছিল। তার মধ্যে চলতি বছরে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে ১৫ বিঘা। জীবিকা নির্বাহের জন্য তার একমাত্র ভরসা কৃষিকাজ। তাই সেই ১৫ বিঘা জমিতে এবার পেঁয়াজ, ধান, মরিচ ও মুলাসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করেছিলেন। অসময়ে পদ্মার ভাঙনে সেসবও বিলীন হয়ে গেছে। এখন সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব তিনি।

রাজবাড়ী সদর উপজেলার বড় চর বেনিনগর, কালিতলা, চর নারায়নপুর, বড় চর, মেছোকাটা গ্রামে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে হারুন মোল্লার মতো অনেক কৃষকের সবজি ক্ষেত উচ্ছে, পটল, ঢেঁড়স, মুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক কৃষক নদী ভাঙনের খবর পেয়ে পাড়ে এসে ভিড় করছেন। এসব এলাকায় ভাঙন রোধে কোনও কার্যক্রম নিতে দেখা যায়নি পানি উন্নয়ন বোর্ডের।

সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চরনারায়নপুর গ্রামের কৃষক লালমিয়া সরদার বলেন, ‌‘শীত মৌসুমে সবজি বিক্রির টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে। কিন্তু এবার সব নদীতে চলে গেছে। চলতি বছরে যে পরিমাণ ক্ষতি হলো, তাতে আমার আর সংসার চালানোর মতো কোনও উপায় থাকলো না। কীভাবে সংসার চালাবো? চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার সংসার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে গেছে। কীভাবে বাঁচবো? এখন এই মাঠে আসার কোনও উপায় নেই। ভাঙতে ভাঙতে আর কিছুই রইলো না। পদ্মা সব গিলে খেলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধান লাগিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই ধান কাটবো, বাজারে বিক্রি করবো, খর গরু-ছাগলকে খাওয়াবো, ধান থেকে চাল হলে পরিবার নিয়ে দুই বেলা ভাত খাবো, কিন্তু তা আর হলো না। আমার এখন চোখে ঘুম নেই, পেটে ভাত নেই, কীভাবে চলবো সেই চিন্তায় দিন পার করছি।’

সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের লালগোলা এলাকায় গত কয়েক দিনের ভাঙনে নদীর তীররক্ষা বাঁধের প্রায় ৮০ মিটার এলাকার সিসি ব্লক নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে লাল গোলা এলাকায় বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

স্থানীয়রা বলছেন, ভাঙন রোধে স্থায়ী কোনও পদক্ষেপ না নিলে জেলার আরও অনেক কৃষকের ফসলি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে যাবে।

বড় চর নারায়ণপুর গ্রামের হাসমত বেপারী বলেন, ‘ভাঙন শুরু হলে নদীতে যারা বস্তা ফেলে তারা তো বড় চোর। ১০০ বস্তা জিওব্যাগ ফেললে বলে দশ হাজার বস্তা ফেলেছি। ঠিকমতো বস্তা ফেললে নদী এমনভাবে কখনোই ভাঙতো না। এখন আমরা তো অসহায়, আমাদের জায়গা-জমি সব নদীতে চলে গেছে। বাঁধেও জায়গা নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের মুখের দিকে একটু তাকান তাহলে আমরা ঠাঁই পাবো। তা না হলে আমাদের ভেসে বেড়ানো লাগবে।’

সোবাহান মোল্লা নামে আরেকজন বলেন, ‘প্রতি বছর যে বালুর বস্তা ফেললে ভাঙন একটু ঠেকে, বস্তা ফেলা বন্ধ করলে আবার যা তাই হয়ে যায়। আমার এক দাগে তিন পাখি জমি ছিল, সেসব এখন নদীর পেটে। এ বছর এই এলাকায় ১০০ বিঘার বেশি জমি নদীতে ভেঙে গেছে।’

রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিরাজ শেখ বলেন, ‘এ বছর বর্ষা মৌসুমে জুলাই-অক্টোবর রাজবাড়ীতে ২৯ হেক্টর ২১৭.৫ বিঘা জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে আবাদি জমি ১৭.৫ হেক্টর ১৩১ বিঘা।’

রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, ‘পদ্মা নদীতে অক্টোবর মাসে অস্বাভাবিক হারে পানি বাড়ছে। নেপালে পানির ঢল ও ভারতে অতি বৃষ্টির কারণে উজান থেকে সেই পানি পদ্মায় প্রবেশ করেছে। ফলে নদীতে পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণনের কারণে রাজবাড়ী সদর ও পাংশা উপজেলায় কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। যেসব জায়গায় আমাদের স্থায়ী কাজ চলছে, সেখানে ভাঙন দেখা দিলে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে তা ভাঙন রোধ করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভাঙন ঠেকাতে তৎপর আছি। পদ্মায় পানি কমতে থাকলে ভাঙন দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। বেনিনগর ও মহাদেবপুর এলাকা আমাদের স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষা কাজ নেই। অলরেডি আমাদের একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে ওই জায়গাগুলো নির্ধারণ করে বোর্ডে পাঠিয়েছি। সেটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যেসব এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দফতরকে অবগত করেছি। তাদের নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’

সারাদেশ-এর আরও খবর