দালাল উচ্ছেদে থানায় কয়েক দফা চিঠি: পাসপোর্টে এখনো ভোগান্তি

ফরম পূরণের নামে চক্রের জালে জড়াচ্ছে সেবাগ্রহীতা : থমকে আছে এজেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া

  বিশেষ প্রতিনিধি    26-01-2023    214
দালাল উচ্ছেদে থানায় কয়েক দফা চিঠি: পাসপোর্টে এখনো ভোগান্তি

খুপরির মতো দেখতে সারি সারি দোকান। বাইরে থেকে মনে হবে কম্পিউটার-ফটোকপির দোকান। কিন্তু ভেতরে ব্যবসা ভিন্ন। প্রকাশ্যে চলছে পাসপোর্ট নিয়ে জাল-জালিয়াতির কারবার। ভুয়া সিল প্যাড ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যাবতীয় নকল কাগজপত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে সব। সরেজমিন দেখা যায়, বেশিরভাগ পাসপোর্টপ্রত্যাশী ই-পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে গিয়ে দালালের ফাঁদে পড়ছেন। ফরম পূরণ শেষ হলেই দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট করার অফার দেন দালালরা।

পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য টাকার অঙ্ক ভিন্ন। যেমন সিরিয়াল ছাড়া আবেদন জমা করতে ১ থেকে ৫ হাজার, পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট পেতে ২০ হাজার টাকা। অবশ্য আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে দালাল উচ্ছেদে শেরেবাংলা নগর থানা ও র‌্যাবকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে পাসপোর্ট অধিদফতর। সর্বশেষ গত বছরের ১০ নভেম্বর এই চিঠি দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল আমাদের সময়কে বলেন, অফিসে তাদের লোক আছে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত সমস্যা শুনে সংশ্লিষ্ট লোককে তারা ফোন দেন। সবুজ সংকেত পাওয়ার পর তারা কাজ হাতে নেন। কয়েকজন পাসপোর্ট দালাল আরও জানান, পাসপোর্ট দালালির কাজে তাদের প্রত্যেকের গড়ে দৈনিক আয় হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ভুয়া নাম-ঠিকানায় জাল পাসপোর্ট তৈরি, আঙুলের ছাপ জালিয়াতি (মিসফিঙ্গারিং) ইত্যাদি কাজ পেলে তাদের আয় বহুগুণ বেড়ে যায়।

সেবাগ্রহীতারা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্ট করতে গেলে পদে পদে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। অথচ পাসপোর্ট অফিসের সামনে কিছু পয়সা খরচ করলেই সবকিছু খুব সহজ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই দালালদের শরণাপন্ন হচ্ছেন তারা। দালালরা ইচ্ছেমতো অর্থ আদায় করছেন সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে।

সরেজমিন দেখা যায়, অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেই তাকে ডাকাডাকি করছেন যুবক ও মধ্যবয়সী কয়েক ব্যক্তি। প্রথমে তারা মূলত সেবাপ্রত্যাশীদের অনলাইন আবেদন ফরম পূরণ করে দেওয়ার অফার দেন। তাদের কাছে নিয়ে যেতে চক্রের অন্য সদস্যরা তৎপর থাকেন পাসপোর্ট অফিসের গেটের আশপাশে। রাস্তার বিপরীত পাশের একটি মার্কেটেও রয়েছে দালালদের অবস্থান। তারা ফরম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট দ্রুত করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছেন সাধারণ মানুষকে।

এদিকে গত ১২ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে পাসপোর্ট অফিসে গ্রাহক হয়রানি ও দালালদের দৌরাত্ম্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। এমনকি ছদ্মবেশী দুদক কর্মকর্তারাও রক্ষা পাননি দালালদের খপ্পর থেকে। দুদক সূত্রে জানা যায়, দুদক টিম পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশকালে প্রধান ফটকেই বেশ কয়েকজন দালাল অর্থের বিনিময়ে সেবা দেওয়ার কথা বলে এগিয়ে আসে।

তাদের সঙ্গে কথা বলে ওই অফিসের কিছু কর্মচারী এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অফিসের অভ্যন্তরে কয়েকজন সেবাপ্রার্থী দালালদের দৌরাত্ম্য, চরম অব্যবস্থাপনা ও অর্থের বিনিময়ে লাইন ব্রেক করে সিরিয়াল সামনে নিয়ে আসার অভিযোগ করেন। সরেজমিনে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ সময় দুদক কর্মকর্তারা গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে বেশকিছু সুপারিশ করেন।

অন্যদিকে পাসপোর্ট সেবা সহজ করতে ‘এজেন্ট’ নিয়োগের বিষয়টি পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। দালালের উৎপাত বন্ধ এবং সেবাপ্রত্যাশীরা ঘরে বসেই এজেন্টের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাতে পারবেন- এমন চিন্তা থেকে বছর কয়েক আগে পরিকল্পনাটির তথ্য জানিয়েছিল পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এ বিষয়ে একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। তবে এরপর আর অগ্রগতি হয়নি।

২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি তখনকার বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ রেজওয়ান সাংবাদিকদের কাছে ‘পাসপোর্ট এজেন্ট’ নিয়োগের পরিকল্পনা জানান। সে সময় এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা করে অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এজেন্টদের বাছাইয়ে অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককে প্রধান করে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে বছর শেষে বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতির আর কোনো তথ্য মেলেনি। এদিকে পাসপোর্ট পেতে দীর্ঘসূত্রতা ও দালালদের দৌরাত্ম্যের ব্যাপারে কথা বলতে মহাপরিচালককে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। দুদক অভিযানে দালালদের দৌরাত্ম্য ও ভোগান্তির সত্যতা পেয়েছে, এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে উপমহাপরিচালক সেলিনা বানু দুদকের কোনো অভিযানের বিষয়ে জানেন না বলে জানান। তবে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, অফিসের ভেতরে দালালদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে অফিসের বাইরে ফরম পূরণ ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা নিতে যান সেবাপ্রত্যাশীরা। তখনই দালালদের খপ্পরে পড়েন। তিনি বলেন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রক্রিয়া অটোমেটেড সিস্টেম। এখানে দালালদের টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই।

দালালদের দৌরাত্ম্য এর পরও কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে অফিসের সামনের সব কম্পিউটারের দোকান তুলে দিয়েছি। তবে ফুটপাত থেকে ওরা সরছে না। ওরা বলে, এটা পাসপোর্ট অফিসের জায়গা না। অফিসের বাইরে হলে আমাদের কিছু করার থাকে না। এরপরও বিভিন্ন সময় আমরা অভিযান পরিচালনা করি। দালালদের ধরে ভুক্তভোগীদের মাধ্যমে মামলাও হয়েছে। থানায় ও র‌্যাবে আমরা কয়েক দফা চিঠি দিয়েছি রাস্তার ওপর এসব দোকান ও দালাল উচ্ছেদের জন্য।

শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের সামনের দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সম্প্রতি দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে পাসপোর্ট অফিসের সামনের ফুটপাতে দোকান থাকলে সেটা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের, পুলিশ তাদের সহযোগিতা করে। এসব দোকান তুলে দেওয়ার ব্যাপারে পাসপোর্ট অফিসের কাছ থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা পাননি। নির্দেশনা পেলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

সূত্র জানায়, ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে বর্তমানে ২৫৬০টি আবেদন প্রক্রিয়া করার সক্ষমতা আছে। জমা পড়ে ৩ হাজারের বেশি আবেদন। এত মানুষ দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এ ছাড়া এই ৩ হাজার জনের সঙ্গে থাকে তাদের প্রায় দুই হাজার আত্মীয়স্বজন। এ ছাড়া পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতেও একই পরিমাণ লোক আসে। আবার ভুল তথ্য সংশোধন চেয়েও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক আসে। প্রতিনিয়ত এ বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করছে। পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। বাইরেও থাকে লোকের দীর্ঘ লাইন।

কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে যে জনবল ও জায়গা রয়েছে, তাতে এক হাজার আবেদন জমা পড়লে সুন্দরভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের অবকাঠামো এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেবা দেওয়ার উপযোগী নয়। কর্মকর্তারা বলছেন, এত আবেদন সঠিক সময়ের মধ্যে সমাধান করে সেবা দিতে চাইলে শুধু ঢাকাতেই জরুরি ভিত্তিতে আরও অন্তত ১০টি অফিস দরকার।

পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি ও দালালদের দৌরাত্ম্যের জন্য জনবল সংকট ও আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে অধিক সেবাপ্রত্যাশীর চাপকে কারণ বলছেন কর্মকর্তা। অবশ্য ইতিমধ্যে ঢাকার মতিঝিল ও মোহাম্মদপুর বসিলাতে দুটি অফিস তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কাজ চলমান আছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ছে, সে অনুযায়ী সেবা দিতে চাইলে শুধু ঢাকাতেই আরও অন্তত ১০টি অফিস দরকার। আর জনবল না বাড়ালে কোনোভাবেই কাক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব না। অন্তত আরও ২৩০ জনের মতো জনবল দিলে সেবার মান ভালো করা সম্ভব।

সারাদেশ-এর আরও খবর