শখের বসে শুরু, মঈন উদ্দিনের হরিণ খামার এখন পর্যটনকেন্দ্র

  বিশেষ প্রতিনিধি    05-11-2022    226
শখের বসে শুরু, মঈন উদ্দিনের হরিণ খামার এখন পর্যটনকেন্দ্র

শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে। শখের বসে রংপুর চিড়িয়াখানা থেকে ১১টি হরিণ কিনে পোষা শুরু করেন প্রবাসী মঈন। এখন অনেকটা বাণিজ্যিকভাবে হরিণের খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর এলাকায় হিলসডেল মাল্টি ফার্ম ও মধুরিমা রিসোর্টে এ দৃষ্টিনন্দন হরিণের খামারটি রয়েছে।

হরিণের খামার ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসছেন নানা বয়সী ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। শুধু হরিণ নয়, নানা প্রজাতির গাছ দিয়ে সাজানো এই খামারে রয়েছে হরেক রকমের পাখি আর জীবজন্তু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নে ৩৫ একর জায়গায় প্রায় চল্লিশ হাজার নানা প্রজাতির গাছ দিয়ে সাজানো এই খামার। তবে এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো হরিণ। সরকারি নিয়মনীতি এবং প্রাণিসম্পদ বিভাগের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠছে এখানকার হরিণগুলো। হরিণের বিচরণ আর প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই এখানে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। হরিণগুলোর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ও রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখতে তদারকি করছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ। খামারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘হিলসডেল মাল্টি ফার্ম’।

খামারের উদ্যোক্তা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মঈন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে ৩৬ বছর প্রবাস জীবনযাপন করলেও হরিণ প্রেমের কারণে দেশেই হরিণের খামারটি গড়ে তুলেছি। অলিনগরে হরিণ খামার ছাড়াও পশুপাখির অভয়াশ্রম তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে খুব বেশি লাভজনক না হলেও শুধু ভালোবাসা থেকেই হরিণ পালন করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, খামারটি এখন দর্শনার্থীদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এখানে হরিণ ছাড়াও গড়াল, ঘোড়া, খরগোশ, ময়ূর, রাজহাঁস, দেশি-বিদেশি হাঁস, কালিম পাখি, ঘুঘু, বন মোরগসহ নানা প্রজাতির পাখি রয়েছে।

হরিণের খামারের লাইসেন্স পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে বলে জানান মঈন উদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৩ সালে লাইসেন্স পাওয়ার পর বাণিজ্যিক খামার শুরু করেছি। প্রথমে রংপুর চিড়িয়াখানা থেকে ২৫ হাজার টাকা করে ১১টি হরিণ কিনে আনি। এরপর একটা পর্যায়ে সেখান থেকে বংশ বিস্তার করে ২৬টি হরিণ হয়েছিল। একবছর আগে বজ্রপাতে তিনটি হরিণ মারা যায়। তবে হরিণ বিক্রিতে ক্রেতাকে অবশ্যই বনবিভাগ থেকে লাইসেন্স ও পজেশন নিতে হবে।

খামারি মঈন উদ্দিন বলেন, একটা সময় জবাই করে খাওয়া গেলেও ২০১৮ সালে নতুন নীতিমালার কারণে হরিণ জবাই করা নিষিদ্ধ। হরিণের তেমন রোগ বালাই হয় না। তবে কখনো কখনো ডিয়ার টোবাকুলাস হয়। আমাদের দেশে এই রোগের ভ্যাকসিন নেই। মূলত পুরুষ হরিণের সিংয়ের গুতায় আহত হয়ে অনেক সময় হরিণের মৃত্যু হয় এবং ছোট বাচ্চাগুলো ঠান্ডাজনিত কারণে মারা যায়। নিয়মিত কৃমি মুক্ত ও ভালোমানের খাবার এবং মিনারেল দিলে হরিণের অসুখ খুব একটা হয় না। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস নিয়মিত হরিণগুলোর তদারকি করে।

হরিণ সবধরনের টকজাতীয় ফল পছন্দ করেন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমলকি, বহেরা, হরিতকি, কামরাঙ্গা, জলপাই, আম, জাম, তেঁতুলসহ নানা গাছের বাগান করেছেন মঈন উদ্দিন। হরিণের চাহিদা মিটিয়ে বাকিগুলো বাজারে বিক্রি করা হয়। শীত মৌসুমে সবজি চাষ করে হরিণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা যায়। এবার ৩০ শতক জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণে হাইব্রিড ঘাস চাষ ও কলমি চাষ করছেন।

হরিণকে নিয়মিত ভুট্টা ভাঙা ও গমের ভুসি দিতে হয়। এছাড়া সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে দানাদার খাবার ও রকসল্ট দিতে হয়। হরিণ দেখাশোনা করার জন্য মাসিক বেতনে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মঈন উদ্দিন বলেন, ‘কোনো হরিণ মারা গেলে কিংবা জন্ম নিলে ১৫ দিনের মধ্যে সনদসহ বন অধিদপ্তরে জানাতে হয়। প্রতি বছর সরকারকে হিসেব দিতে হয় এবং হরিণপ্রতি ১০০০ টাকা ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন ও পজেশন সার্টিফিকেট নেওয়া লাগে। নতুন খামারির কাছে আমরা একটি হরিণ ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করি।’

সরকারি বন থেকে আট কিলোমিটারের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে হরিণ পালন করা যায় না। আবার খামার করতে হয় লোকালয় থেকে দূরে কোথাও। কোনো হরিণ জন্ম নিলে সেই তথ্য জানাতে হয় সরকারকে। কোনো হরিণ মারা গেলে কিংবা বিক্রি করলে সেই খবরটাও ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে হয় বন বিভাগকে। বাণিজ্যিকভাবে হরিণ পালন করতে হলে মানতে হয় সরকারের সুনির্দিষ্ট এমন কিছু কঠিন শর্ত। সরকারের বেধে দেওয়া কঠিন এসব শর্ত মেনেই হরিণ পালন করছেন মঈন উদ্দিন।

প্রাকৃতিকভাবে প্রধান খাবার ঘাস হলেও প্রতিদিন একটি চিত্রা হরিণকে দুই কেজি করে ভুট্টা দিতে হয়। তা না হলে হরিণের স্বাভাবিক শারীরিক গঠন হয় না। সুস্থ রাখতে হলে ঘাস, ঔষধি গাছ, টকজাতীয় ফলসহ পরিবেশ উপযোগী খাবার চিত্রা হরিণকে দিতে হয়।

মঈন উদ্দিন বলেন, শুধু ভুট্টার পেছনে বছরে ৫-৬ লাখ টাকা খরচ হয়। এছাড়া ঘাস ও টক ফলের পেছনেও অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

বছরে একবার বাচ্চা দেয় হরিণ। দেড় বছর পর থেকে বাচ্চা প্রসব শুরু করে স্ত্রী হরিণ। জন্মের পর বাচ্চার শরীরে হাত দিলে হরিণ সে বাচ্চাকে সহজে দুধ দেয় না। ছয় মাস পর একটি হরিণের ওজন হয়ে থাকে প্রায় ২০ কেজির বেশি।

খামারি মঈন উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, দেশে একসময় পাঁচ প্রজাতির হরিণের দেখা মিললেও এখন শুধু চিত্রা ও মায়া জাতটি চোখে পড়ে। সাম্বার, বারোশিঙ্গা ও নাত্রিনি বা পারা হরিণ আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পরিবার নিয়ে মঈন উদ্দিনের হরিণের খামার দেখতে আসা স্কুলশিক্ষক হামিদা আবেদীন পলি জাগো নিউজকে বলেন, প্রথমে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু, ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে আসতে খুব বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু হিসলডেল মাল্টি ফার্মে প্রবেশ করে হরিণের খামার দেখে মুহূর্তে সব কষ্ট ভুলে গেছি। অনেক সুন্দর একটি জায়গায় খামারটি করা হয়েছে।

করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন জাগো নিউজকে নয়ন বলেন, ‘মঈন ভাইয়ের গড়ে তোলা হরিণ খামারটি এলাকাবাসীর কাছে বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই দর্শনার্থীর ভিড় থাকে খামারটিতে। চট্টগ্রাম, ফেনী, মিরসরাই, কুমিল্লা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ হরিণ দেখতে আসছেন।’

মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাকিরুল ফরিদ বলেন, ‘আমি এখানে নতুন দায়িত্বে এসেছি। এখনো অলিনগরে অবস্থিত হরিণের খামারে যাওয়া হয়নি। তবে অফিস স্টাফদের কাছ থেকে বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছি।’

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন জাগো নিউজকে বলেন, অলিনগরে অবিস্থত হরিণ খামারটি আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করে থাকি। জায়গাটি অনেক সুন্দর। খামারের মালিক আইন মেনেই হরিণ পালন করছেন। তিনি বলেন, হরিণের অনেক প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এভাবে হরিণ পালন ইতিবাচক।

সারাদেশ-এর আরও খবর