দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্প : সেপ্টেম্বরে রেলপথ চালু করতে ২০ কিলোমিটারের চ্যালেঞ্জ

  বিশেষ প্রতিনিধি    25-06-2023    101
দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্প : সেপ্টেম্বরে রেলপথ চালু করতে ২০ কিলোমিটারের চ্যালেঞ্জ

সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। চলতি জুনের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল, কিন্তু করোনাকালে কাজের গতি কমে আসায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। সম্প্রতি রেলপথমন্ত্রী আগামী সেপ্টেম্বরে প্রতীক্ষিত প্রকল্পটি চালুর মাধ্যমে ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণা অনুযায়ী ট্রেন চলাচল শুরু করতে ২০ কিলোমিটার রেলপথই মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে রেলওয়ের কাছে।

সর্বশেষ ৩১ মে পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌতকাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। ১০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পটিতে এরই মধ্যে ৮০ কিলোমিটার রেলপথ বসানো হয়েছে। সরকারি ঘোষণার পর বাকি ২০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে দ্রুত কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে রেলপথ বসানোর কাজ শেষ করতে না পারলে শেষার্ধে ট্রেন চলাচল শুরু করা সম্ভব হবে না। যার কারণে বাড়তি শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে কার্যক্রম শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ১৫৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে দোহাজারী পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার পুরনো রেলপথ। প্রকল্পের অধীনে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণকাজের দায়িত্ব পায় ম্যাক্স ও তমা নামের দুটি বাংলাদেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ম্যাক্স কর্তৃপক্ষের প্যাকেজে রেলপথ বসানোর কাজ শেষ হলেও তমা কনস্ট্রাকশন এখনো ২০ কিলোমিটার রেলপথ বসাতে পারেনি। যার কারণে আগামী সাড়ে তিন মাসের মধ্যে নতুন এ রেলপথে ট্রেন সার্ভিস চালুর বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে চলতি জুন পর্যন্ত করা হয়। কভিডকালীন প্রকল্পের কাজ কিছুটা মন্থর হয়ে যাওয়ায় মেয়াদ বাড়ানো হয় সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পটি। তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন হলে আরো ১০ শতাংশ কাজ চালু হওয়ার পর শেষ করতে হবে। এতে কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন ছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অসমাপ্ত রেখেই রেলপথ বাণিজ্যিকভাবে চালু করতে হবে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমরাও সেপ্টেম্বরকে সামনে রেখে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ১০০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাকের মধ্যে ৮০ কিলোমিটারের রেলপথ বসানো হয়ে গেছে। বাড়তি লোকবল নিয়োগ ছাড়াও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রয়োজনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালু করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে কিছু কাজ বাকি থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ থাকায় ট্রেন সার্ভিস চালুর পর বাকি কাজ শেষ করা হবে।’

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প হলেও রেলপথটি নির্মাণের ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ রেলপথের প্রধান বাধা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রায় শতবর্ষী একটি মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু। সেতুটি ভেঙে একই স্থানে একটি নতুন সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি রেলওয়ে। সর্বশেষ নতুন সেতু নির্মাণের আগে পুরনো সেতুটিকে বুয়েটের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করার চিন্তা করছে রেলওয়ে। ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে চলতি জুনে সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ হলেও চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার রেলপথটি রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ পথটিও সংস্কার করে নতুন রেলপথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। কিন্তু এখনো চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে ষোলশহর স্টেশন হয়ে দোহাজারী পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথটি সংস্কারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ। তাছাড়া বর্তমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন চলাচলে ফৌজদারহাট থেকে ষোলশহর স্টেশন পর্যন্ত একটি বাইপাস রেলপথ নির্মাণের কথা থাকলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে ঢাকা কিংবা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ট্রেনকে প্রথমেই চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে ইঞ্জিন উল্টোপথে ঘুরিয়ে কক্সাবাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে। এতেও ট্রেনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছতে ১ থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি সময়ক্ষেপণ হবে।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিল রেলওয়ে। তবে হঠাৎ করে পরিকল্পনা ছাড়াই উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়ায় চ্যালেঞ্জে পড়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। বর্ষা মৌসুমে রেলপথসহ বিভিন্ন ভৌত কাজ সম্পন্ন করা এমনিতে জটিল। ফলে অসমাপ্ত ২০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসাতে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া এখনো কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের স্ট্রাকচার দৃশ্যমান হলেও অর্ধেক কাজ বাকি। সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালু করতে শুধু স্টেশনের প্রয়োজনীয় কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন সার্ভিস চালু করতে রেলের রয়েছে একাধিক পরিকল্পনা। এসব পরিকল্পনা শতভাগ বাস্তবায়নে অন্তত ১০ বছর সময় লাগতে পারে বলে মনে করছে রেলওয়ে।

প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে সব ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। ৮০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হলেও কিছু অংশে ওয়েল্ডিং বাকি রয়েছে। এছাড়া ট্র্যাক বসানোর কাজ শেষ হলেও শতভাগ পাথর বসানোর কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পথের সাতটি নতুন রেলওয়ে স্টেশন স্থাপনকাজ শেষ হয়ে এলেও সিগন্যালিংসহ বেশকিছু কাজ শেষ হয়নি। এক্ষেত্রে প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর এক বছরের ডিফেক্ট লায়াবিলিটিজ পিরিয়ডের (ডিএলপি) মধ্যে অসমাপ্ত কাজ শেষ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত এডিবির অর্থায়নে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, কভিড পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পের নির্মাণ সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল। যদিও কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ তৈরিতে দোহাজারী থেকে মিয়ানমারের গুনদুম সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পটি একনেকে পাস হয় ২০১০ সালে। পরে কয়েক বছর প্রকল্পটি স্তিমিত হয়ে গেলেও ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেলপথটি নির্মাণের কার্যক্রম ফের শুরু হয়।

সারাদেশ-এর আরও খবর